অন্যান্য

একজন মানুষ


রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে আশহাব। তীব্র আলো ফেলে দ্রুত এগিয়ে আসছে মিলিটারি জিপের সারি। বাঁক পেরোলেই হেডলাইটের আলো এসে পড়বে পিঠের ওপর। সেই সাথে ছুটে আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট। সামনেই উঁচু ব্রিজ। ওপাশে অন্ধকারে ঘন ঝোঁপের আড়ালে ওঁত পেতে আছে কয়েকজন অস্ত্রধারী যুবক। মাথায় জটা চুল, মুখে দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গল। ওরা অপেক্ষায় আছে ডিনামাইট চার্জ করে ব্রিজটা উড়িয়ে দেবার জন্যে। তার আগেই আশহাবকে ব্রিজটা পার হয়ে আসতে হবে। প্রাণপণে ছুটছে আশহাব। ব্রিজের মাঝামাঝি পৌঁছে গেছে। ঠিক তখুনি উঁচু ব্রিজের প্রান্তে পৌঁছে যায় প্রথম যানটি। তীরের ফলার মতো ছিটকে আসে হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোকরশ্মি। থমকে যায় আশহাব। এক্ষুণি বৃষ্টির মতো ছুটে আসবে গুলি। খাঁচার পাখিটার দাপাদাপি হঠাৎ যেন বন্ধ হয়ে গেছে। হৃৎপিন্ডটা এসে আটকে আছে গলার কাছে।

জিপগুলোর গতিও মন্থর হয়ে যায়। ধীর গতিতে এগিয়ে এসে থামে কিছুটা অদূরে। নিশ্চল বরফের মতো জমে যাওয়া আশহাব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে সম্মুখে। গাড়ি থেকে নেমে দু’সারিতে এগিয়ে আসে সৈন্যরা। সতর্ক পদক্ষেপ। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু কোনো ভাবান্তর নেই আশহাবের। আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে দু’হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকে।

পাঁচটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজের ওপর। এসময় ব্রিজের ওপাশে ঘন ঝোঁপের আড়াল থেকে ডেকে ওঠে রাতজাগা কোন পাখি। ইঞ্জিনের গর্জনের মধ্যেও সেই ডাকটা এসে পৌঁছায় আশহাবের কানে। সঙ্কেতটা পেয়েই বিজয়ের হাসি ফুটে ওঠে তার চোখে-মুখে। অগ্রসরমান সৈন্যরা তাতে থমকে দাঁড়ায়। আশহাবের হাসিতে স্পষ্টত বিপদের গন্ধ টের পায়। অস্ত্রগুলো আচমকা গর্জে ওঠে। ঝাঁঝরা হয়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আশহাব। কিন্তু বুলেটের আঘাতে ছিঁটকে পড়ে সে আরো দূরে। অথৈ জলে তলিয়ে যাবার আগেই প্রচন্ড বিস্ফোরণে উড়ে যায় নোয়াখালী ব্রিজ।

দুই.
জলের শীতল স্পর্শে চোখ মেলে তাকায় আশহাব। বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে চারিদিক। সেই সাথে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে ক্রমাগত। কোথায় আছে সে হঠাৎ বুঝতে পারে না। এ সময় বিকট বিস্ফোরণের শব্দে ঘোর কেটে যায়। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কাছেই কোথাও বজ্রপাত হয়েছিল। সেই শব্দে ঘুমের রেশটা পুরোপুরি কেটে গেছে। বৃষ্টির ছাটে শরীর বেশ খানিকটা ভিজে গেছে। হাসপাতালের বারান্দায় বসে থেকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল টের পায়নি।

অপারেশন থিয়েটারে প্রসব বেদনায় নীল হয়ে আছে তার স্ত্রী। সংকটাপন্ন একটা মানুষকে রেখে এভাবে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। এরকমই হয় তার। ছেলেবেলায় দাদীর মৃত্যুশয্যায় ঘুমিয়ে পড়ার জন্য ভীষণভাবে ভর্ৎসনা পেতে হয়েছিল তাকে। অবসাদে ক্লান্তিতে ঘুম চলে এলে তাতে তারই দোষ কী! যুদ্ধের সময় শত্রু ক্যাম্পে অপারেশনের আগে অপেক্ষায় থেকে থেকে এভাবেই একবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেজন্য তাদেরকে বেশ বড় রকমের একটা মাশুলও দিতে হয়েছিল। হারাতে হয়েছিল ছয়জন সহযোদ্ধাকে। সে কথা মনে হলে একটা সুতীব্র অপরাধবোধ এসে গ্রাস করে।

সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায় আশহাব। এই চিজটা থেকে তাকে নিবৃত্ত করতে কী যে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ছিল ওর স্ত্রীর। লাভ যে কিছুই হয়নি তা বলা যাবে না। ভীষণরকম চেইন স্মোকার ছিল সে। ওর অনেক মান-অভিমান, অনশনের পর অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। কমিয়েছে স্ত্রীকে ভীষণরকম ভালবাসে বলে। তবে তার ভালবাসার তীব্রতা স্ত্রীর চেয়ে বোধহয় বেশি নয়। পরিমাপ করার ব্যবস্থা থাকলে ওরটাই কিছুটা বেশি হবে। কে বেশি ভালবাসে এ নিয়ে তর্কে কখনো আশহাব জিতেছিল বলে রেকর্ড নেই। ওর ভালবাসা সত্যিই এতটা তীব্র ছিল যে আশহাবকে কথা দিতে হয়েছিল; যেদিন তাদের সন্তানের জন্ম হবে সেদিন পুরোপুরিই নির্বাসনে পাঠাবে প্রিয়তম সিগারেটকে।

দেশলাইটা ফুৎকারে নিভিয়ে তাকিয়ে থাকে হাতে ধরা সিগারেটের দিকে। কেমন যেন একটা মায়া হয়। তারপর সকল দ্বিধাকে সিগারেটের সাথে প্যাকেটবন্ধী করে ছুঁড়ে ফেলে দেয় গ্রিলের বাইরে। অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়ে প্যাকেটটা কোথায় পড়ে, কে জানে! আশহাব একটা দীর্ঘ পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস টেনে নেয় বুক ভরে।

তিন.
সীমান্তের ওপারে গেরিলা ট্রেনিং নিতে যেদিন আশহাবরা পালিয়ে যাচ্ছিল, সেদিনই মানুষটা প্রথম এসেছিল। তাকে বলেছিল বেঁচে থাকার জন্য। বেঁচে ফিরে আসার জন্য। বলেছিল সে তার অপেক্ষায় থাকবে। যুদ্ধের সময়ই আশহাব শুনেছিল পাক বর্বর আর রাজাকাররা এক রাতে তাদের ঘরে আগুন দিয়েছিল। ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে ছাঁই হয়ে গেছে তার বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবগুলি মানুষ। সেই সাথে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় আশহাবের পৃথিবী। বেঁচে থাকার আস্বাদ পুরোপুরিই হারিয়ে ফেলেছিল। তবুও বেঁচে ছিল সে। বেঁচেছিল এবং ফিরে এসেছিল নিজের শূণ্য ভিটেয়।

আশহাবের প্রত্যাবর্তণের খবরে সেদিন গ্রামের মানুষেরা পিঁপড়ের মতো দল বেঁধে এসে জড়ো হয় তার ছোট্ট পোড়াবাড়িতে। কেউ আসে যুদ্ধফেরত মুক্তিসেনাকে একবার দেখতে, আবার কেউ আসে সান্ত্বনা দিতে। তার জন্য অপেক্ষায় থাকা সেই মানুষটিও ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। সেদিন আশহাব শূণ্য ভিটেয় বসেছিল স্তব্দ হয়ে। একসময় দীর্ঘ মৌনতা ভেঙ্গে সে উঠে দাঁড়ায়। শূণ্য হাতে নেমে পড়ে পোড়া ভিটে সংস্কারের কাজে।

সেদিন গ্রামের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মেরামতের কাজে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। কেউ নিয়ে আসে বাঁশ-বেত, কেউ নিয়ে আসে খুঁটি। সকলে মিলে লেগে যায় ঘর তৈরির কাজে। সেদিন আশহাবকে কিছুই করতে দেয়নি গ্রামের মানুষ। বেলা শেষের আগেই পোড়া ভিটের ওপর নতুন ঘর উঠে যায়।

আশহাব শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। মানুষের জন্য মানুষের যে কী অপরীসিম মমতা থাকতে পারে; দেখে দু’চোখ সহসা জলে ঝাপসা হয়ে আসে। এই মানুষের জন্য, এই দেশের জন্য কাজ করতে পেরে সত্যিই তার গর্ব হয়। মুছে যায় সকল দুঃখবোধ।

সেই রাতে গ্রামের সকল মানুষ ফিরে গিয়েছিল। ফিরে যায়নি একজন, শুধু একজন মানুষ।

চার.
রাত দুটো। আশহাবের স্ত্রী মারা গেছে আরও ঘন্টাকাল আগে। সে অবধি আশহাব স্থির বসে আছে। সময়টা যেন ঝুলে আছে কোন এক অনন্ত শূণ্যতার সূতোয়। সদ্যোজাত শিশুটিকে বুকের কাছে আগলে রেখেছেন কয়েকজন মা। জড়ো হওয়া মানুষজন ঘিরে বসে আছে আশহাবকে। নিজের সন্তানকে দেখার কোন আগ্রহই দেখা গেল না। খবরটা শোনার পর থেকে পুরোপুরি পাথর হয়ে গেছে লোকটা। কোন শব্দ নেই, অশ্রু নেই। কেবল স্থির তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিটা ঠিক কোনদিকে তাও বোঝা যায় না। মৃত মানুষের মত ঘোলা, শূণ্য সেই দৃষ্টি।

এসময় পরম মমতা নিয়ে এগিয়ে আসে একজন মানুষ, একজন মা। পরম মমতায় ক্ষুধার্ত সদ্যোজাত শিশুটিকে বুকে তুলে নেন, পান করান মাতৃসুধা। জাত-বিজাত না ভেবে দুগ্ধ পান করানোয় কেউ কেউ ভৎর্সনা করে। কিন্তু আজও মানবতার পরিচয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় সেই মানবতাবাদী মানুষ। বলেন, মায়ের আবার জাত কিরে? মা তো মা-ই!

গভীর শীতঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠা মানুষের মত ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে আশহাব। সুন্দর ফুটফুটে শিশুর মুখটা দেখে বুকের ভেতরটা গুমরে গুমরে ওঠে। অভিমানে বুক ফেটে যায়- সকল দায় চাপিয়ে দিয়ে এভাবে সে চলে যেতে পারল? সব হারানোর বেদনায় বুকের ভেতরটা প্রচন্ডভাবে দুমড়ে মুচড়ে চূর্ণ হতে থাকে। কাঁপা কাঁপা হাতে সদ্যোজাত সন্তানকে বুকে তুলে নেয় আশহাব। তারপর সদ্যোজাত শিশুর সাথে সেও চিৎকার করে করে কাঁদতে থাকে।

লেখক: প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান, সোনাপুর কলেজ, সদর, নোয়াখালী।

মন্তব্য