[পর্ব-১৪: প্রাইমারি স্কুল পর্ব]
দেখতে দেখতে বার্ষিক পরীক্ষার ফল ঘোষণার সময় ঘনিয়ে এলো। কদিন হলো স্কুলে যাই না। মা-নানির মতে, ‘সারাদিন মাঠে মাঠে টইটই’ করে বেড়াই। কারও ক্ষেতের তরমুজ খাই, তো কারও ক্ষেতে বাঙ্গি ছিঁড়ে খাই। কখনো অর্ধেকটা খেয়ে ছুড়ে ফেলি। কখনো গাছ থেকে পাকা টমেটো ছিঁড়ে তাতে আস্ত একটা কাঁচা মরিচ ঢুকিয়ে দেই। এরপর মুখে পুরে দিয়ে গপগপ করে খেয়ে ফেলি।
অবশ্য যাদের ক্ষেত থেকে খাই, তারা দেখলেও কিছু বলেন না। নানার বয়সী যারা, তারা হয়তো বলেন, ‘যা খাইতে পাইরবি, তা খা। বেশি নষ্ট করিস না।’ আমরা তখন মাথা নত করে একটা সালাম ঠুকে সরে পড়ি। অনুমতি দিলে কেমন যেন খাওয়ার আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়।
বিষয়টিতে প্রতিযোগিতার গন্ধ পেয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কারণ আমি কখনোই কোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় কোনোটাই হতে পারিনি। তদুপরি তোতলা। স্যারের প্রস্তাবে সবাই সোল্লাসে বলে, ‘জি স্যার।’ কেবল আমি নীরব।
এদিকে আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফল ঘোষণার আগে নাকি কালচারাল অনুষ্ঠান হবে। আগের হেডস্যার আর নেই। নতুন হেডস্যার এসেছেন, তাও ছয় মাস হবে। তিনি প্রায়ই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করেন। স্কুলের অফিস রুমে। ফল ঘোষণা করার আগে আমরা কয়েকজন প্রায় স্কুলে আসা-যাওয়া করি।
সেদিনও গেলাম। স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়েছি মাত্র। হারমোনিয়ামের সুর ভেসে এলো। আমরা অফিস রুমের জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি, স্যারের চোখ বন্ধ। কণ্ঠে গান, ‘ধনধান্যে পুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা।’ স্যার যেই গাইলেন ‘তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে’, তখন আমাদের ভেতর থেকে কে একজন যেন সজোরে গলা মেলালো। অমনি স্যার বললেন, ‘কে রে?’ আর যাই কই। পালানোর সাহস নেই। আস্তে করে বললাম, ‘আমরা’।
হেডস্যার আমাদের তিন-চার জনকেই ডেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমার সঙ্গে আরও যারা ছিল, তাদের দুজনের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। একজন মোজাম্মেল হক। তার বাড়ি বাংলাবাজার থেকে দক্ষিণ থেকে কোথাও ছিল। আরেকজন সেতারা। তার বাড়ি স্কুলের উত্তর দিকে কোথাও ছিল। বাকিদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। এই দুই জনের নাম মনে পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বলছি সে কথা। তার আগে ভূমিকাটুকু সেরে নেই।
রুমে ঢোকার পর স্যার বললেন, ‘স্কুলে যে কালচারাল অনুষ্ঠান হবে, তোরা জানোছ?’ আমরা ‘হ্যাঁ’-সূচক মাথা নাড়ি। স্যার বলেন, ‘বেশ। তোরা সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিবি। সবাইকে কবিতা আবৃত্তি, গান, নাটকে অংশ নিতে হবে। ভালো করলে পুরস্কার পাবি।’ বিষয়টিতে প্রতিযোগিতার গন্ধ পেয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কারণ আমি কখনোই কোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় কোনোটাই হতে পারিনি। তদুপরি তোতলা। স্যারের প্রস্তাবে সবাই সোল্লাসে বলে, ‘জি স্যার।’ কেবল আমি নীরব।
যখন স্যারের সঙ্গে গলা মেলাই, তখন মনে হয়, আরে গান গাওয়া তেমন আর কী! গাইতে তো পারি। কিন্তু যেই স্যার থেমে যান, আমাকে গাইতে বলেন, অমনি সব এলোমেলো হয়ে যায়।
স্যার আমার তোতলামি-জড়তার কথা জানতেন। আমাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মুসা তোর কী হয়েছে? সমস্যা কী? তুই তো গান-কবিতা আবৃত্তি-নাটকে অংশ নিবি। বলে দিলাম।’ স্যারের মুখে ‘মুসা সম্বোধন শুনে বাকিরা খিল খিল করে হেসে উঠলো। বললো, ‘ও স্যার। হেতার নামতো মুসা নয়। নূরুল হক। আম্নে হেতারে মুসা কন ক্যা।’ স্যার মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন, ‘কারণ আছে। তোরা মুসা নবীর নাম শুনছোস? নবী মুসাও তোতলা ছিলেন। তোরা নূরুল হককে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করিস। এটা ঠিক না। সে একটু তোতল। একটু দুষ্টুমি করে। জানোস তো সে কিন্তু কোরানে হাফেজ?’ স্যারের প্রশ্নে কেউ কেউ চুপ থাকে। কেউ কেউ বলে, ‘জানি স্যার।’
সেদিনই কালচারাল অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে অংশগ্রহণকারী হিসেবে প্রায় ২০ জনের তালিকা করলেন। আমাকে গান-কবিতা-কোরআন তেলাওয়াত-নাটক; এই চার বিভাগে রাখলেন। বললেন, ‘সব বিভাগেই অংশ নিবি। কোনো সমস্যা নাই।’ সেদিনের পর থেকে টানা একসপ্তাহ আমাদের রিহার্সেল চললো। স্যার আমাকে ও সেতারাকে শেখালেন, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গান। আমাকে এককভাবে শেখালেন কাজী নজরুলের ‘সংকল্প’।
আর ছয় জনকে শেখালেন ‘ষড়ঋতু’ নামের একটি নাটিকার ছয় ঋতুর চরিত্রে অভিনয়। আমি পেলাম ‘শরৎ কাল’। মোজাম্মেল হক ‘হেমন্ত কাল’ ও বাহাউদ্দিন ‘বসন্ত কাল’ চরিত্র পেলো। এরমধ্যে মোজাম্মেল হক ও আমি ক্লাস ফোর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছি। বাহাদ্দিন ক্লাস থ্রি থেকে আর সেতারা ফাইভ থেকে পরীক্ষা দিয়েছে। নাটিকার বাকি তিন জনের কথা মনে পড়ছে না। ও হ্যাঁ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছিল গোল্লাছুট, হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, ফুটবল খেলাও।
বার্ষিক অনুষ্ঠানের আগের পুরো এক সপ্তাহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রেহার্সেল করলাম। প্রাইমারি স্কুলটি ছিল দক্ষিণমুখী। স্কুলের সামনে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা মাঠ। মাঠের পূর্বপাশে বাংলাবাজার টু দুই নম্বর সিটের রাস্তা।
একদিন আমরা স্কুলের ক্লাসরুমগুলোয় গান-কবিতা-নাটকের রিহার্সেল করছি। আর বাইরে স্কুলের মাঠে ফুটবল, গোল্লাছুট, হাডুডুর প্র্যাকটিস চলছে। বাইরে হইহল্লা, ভেতরে সুরের আরাধনা। স্যার হারমোনিয়াম বাজিয়ে একের পর এক গান করছেন। আমরা তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছি। যখন স্যারের সঙ্গে গলা মেলাই, তখন মনে হয়, আরে গান গাওয়া তেমন আর কী! গাইতে তো পারি। কিন্তু যেই স্যার থেমে যান, আমাকে গাইতে বলেন, অমনি সব এলোমেলো হয়ে যায়।
স্যার বলেন, ‘তাদের বিচার হবে। তোরা এখন রিহার্সেল কর।’ এরপর হেডস্যার ঢুকলেন অফিস রুমে। একটা বেত নিয়ে মাত্র সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়ালেন। অমনি ভোজভাজির মতো ঘটে গেলো ঘটনা।
আমরা গলা সাধছি, অমনি হঠাৎ কেউ একজন ‘ও মাগো’ বলে মাঠে চিৎকার করে উঠলো। ওই মর্মন্তুদ শব্দ শুনে হেড স্যার বললেন, ‘দ্যাখ তো কী হয়েছে? কে চিল্লায়?’ দরজার কাছে আমি ছিলাম। খুলে বেরিয়ে এলাম। মাঠে নামতেই দেখি হাডুডুর কোর্টে একজন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আর চিৎকার করে কাঁদছে।
ঘটনা কী? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে এখানে হাডুডু সম্পর্কে বলে নেই। এই খেলায় দুই পক্ষ থাকে। একপক্ষে দুই জন থেকে শুরু করে এগারো-বারোজন পর্যন্ত থাকে। খেলার জন্য দুটি সমান আকারের কোর্ট থাকে। মাঝখানে থাকে সীমানা রেখা। খেলার নিয়ম অনুযায়ী এক পক্ষের একজন নিজেদের কোর্ট থেকে সীমারা রেখা পার হয়ে প্রতিপক্ষের কোর্টে ঢুকে পড়ে। তার মুখে থাকে গঁৎবাঁধা বোল। কেউ কেউ কেবল ‘হা-ডু-ডু-হা-ডু-ডু’ কেউবা ‘কাবাডি-কাবাড়ি-কাবাডি’ বলে বোল দেয়। এই বোল দেওয়ারও রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন। নিয়ম অনুযায়ী—বোলদাতা যতক্ষণ প্রতিপক্ষের কোর্টে থাকবে, ততক্ষণ বোল বলে যেতে হবে। মাঝখানে বিরতি দেওয়া যাবে না। আর সশব্দে ‘হা-ডু-ডু, হা-ডু-ডু’ বা ‘কাবাডি-কাবাডি-কাবাডি’ বোল দিতে দিতে প্রতিপক্ষের যেকোনো একজন খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে নিজের কোর্টে ফিরে যেতে হবে। আর প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দেরও চেষ্টা থাকবে ওই বোল দাতাকে জাপটে ধরে আটকে রাখা। জাপটে ধরার পরও বোলদাতা খেলোয়াড় চেষ্টা করবে দম ধরে রেখে নিজের কোর্টে ফিরে আসতে। অন্তত সীমারেখা ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। দম ধরে রেখে নিজের কোর্টে ফিরে আসা বা সীমারেখা স্পর্শ করতে পারলে তার দল এক পয়েন্ট পাবে। যদি বোলদাতার দম ফুরিয়ে যায়, প্রতিপক্ষরা একপয়েন্ট পাবে।
তো হেড স্যারের নির্দেশে বাইরে এসে দেখি, একজন বোল দিতে এসে ধরা পড়ে গেছে প্রতিপক্ষের কোর্টে। সে উপুড় হয়ে আছে। আর চিৎকার করে কাঁদছে। ঘটনা কী, জানতে চাইলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়—প্রতিপক্ষের সাত/আটজন মিলে তাকে জাপটে ধরেছিল। তবু সে দম ছাড়েনি। কেবল ‘কাবাডি-কাবাডি-কাবাডি’ বোল দিয়েই যাচ্ছিল। আর প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রাও তাকে চেপে ধরে রেখিছিল। সেও প্রাণপণে চেষ্টা করেছে কোনোভাবে সীমারেখা স্পর্শ করতে। কিন্তু প্রতিপক্ষের একজন এসে তার সামনের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাতের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে। তাতেই সে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। এ কারণেই ওই মর্মন্তুদ চিৎকার।
এবার ক্লাসরুমে ফিরে স্যারকে ঘটনা সবিস্তারে বলি। স্যার বলেন, ‘তাদের বিচার হবে। তোরা এখন রিহার্সেল কর।’ এরপর হেডস্যার ঢুকলেন অফিস রুমে। একটা বেত নিয়ে মাত্র সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়ালেন। অমনি ভোজভাজির মতো ঘটে গেলো ঘটনা। যে যার মতো দৌড়ে পালালো। স্যার হাসতে হাসতে ক্লাসরুমে ঢুকে বললেন, ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই। দুষ্টুগুলো সব পালায়ছে।’
মুহূর্তেই কেমন যেন পুরো মঞ্চে বিষাদ নেমে এলো। হেড স্যার এবার মাইক্রোফোন হাতে নিলেন। কোনো ভূমিকা না করেই পরবর্তী পুরস্কারজয়ীদের ডাকা শুরু করলেন।
এদিকে, দেখতে দেখতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন এসে গেলো। অনুষ্ঠান শুরু সন্ধ্যায়। শুরুতে অতিথিবরণ। যতদূর মনে পড়ে—প্রধান অতিথি আব্দুল মালেক উকিল। ‘আমার গানের মালা আমি করবো কারে দান’—এই গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ক্লাস ফাইভের ফলপ্রার্থীরা প্রধান অতিথিকে বরণ করে নিলো। গলায় পরালো গাঁদা ফুলের মালা। এরপরই শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বেশি হাততালি পড়েছে আমার সহপাঠী (আমার চড় খাওয়ার পর যার জ্বর হলো। এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগে মারা গেলো) আমির হোসেনের বড় বোনের গাওয়া একটি গানে। গানটি ছিল, ‘আমার কাঁখের কলসী মাঝি গিয়াছে ভাসি’। এরপরই নাচের জন্য মুহুর্মুহু করতালি। হিন্দিগানের সুরে সুরে বেদেনীর নাচ নেচেছিল রীনা নামে এক ছাত্রী। সে তখন ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠবে মাত্র।
গান-কবিতা-কোরআন তেলাওয়াত-নাটিকা-নাট শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। পুরস্কার বলতে গ্লাস, প্লেট, কাপ-পিরিচ। তবে সেই অনুষ্ঠান ছিল আমার দেখা সবচেয়ে ব্যতিক্রম আয়োজিন। হেডস্যার বললেন, ‘আজকের অনুষ্ঠানে কোনো প্রতিযোগিতার ব্যাপার নেই। এই অনুষ্ঠানের বড় কথা হলো অংশগ্রহণ। আমি মনে করি, কোনো কাজে অংশগ্রহণ করাটাই আসল। প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় হওয়া বড় কথা নয়।’ স্যারের কথাগুলো শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। আমি পুরস্কার আনতে গিয়ে কেঁদে ফেলি। এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে বিশাল মঞ্চে উঠে মালেক স্যারের (ইনি সহকারী শিক্ষক) হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছি। আমার চোখের জল হেড স্যারের দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি টেবিলের ওপাশ থেকে আমার কাছে চলে এলেন। তার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। স্যার বললেন, ‘তুই আমার মুসা। কাঁদিস না পাগলা। দোয়া করি একদিন অনেক বড় হবি। যা। তোকে কোনো প্রতিযোগিতায় জিততে হবে না। জীবনে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশও নিতে হবে না। তোর সঙ্গে সারাজীবন আমার দোয়া থাকবে।’
হেড স্যারের কথা শুনে মঞ্চের অনেকেই জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। তিনি কাউকে কিছু বললেন না। ভারী কালো ফ্রেমের চশমাজোড়া খুলে পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে মুছলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছলেন চোখ। মুহূর্তেই কেমন যেন পুরো মঞ্চে বিষাদ নেমে এলো। হেড স্যার এবার মাইক্রোফোন হাতে নিলেন। কোনো ভূমিকা না করেই পরবর্তী পুরস্কারজয়ীদের ডাকা শুরু করলেন।
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-১৩