গত ২২ এপ্রিল বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী চৌরাস্তার পশ্চিম পাশে আবাসিক এলাকা ‘আপন নিবাস’র এক যুবক ও তার মায়ের শরীর থেকে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা নেওয়া হয়। যেহেতু তার কয়েকদিন আগে ওই যুবকের সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। যার ফল আসে গত ২৯ এপ্রিল। ফলে, তাদের দুজনের শরীরেই করোনা পজেটিভ আসে। অর্থাৎ সাতদিন পরে ফল আসে। এর মধ্যে ওই যুবক বা তার মা মারাও যেতে পারতেন। যাই হোক, তিনি ও তার মা বেঁচে গেছেন। কিন্তু ওই যুবক বেঁচে গিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষকে। নিশ্চই এখন প্রশ্ন করবেন কিভাবে?
ওই যুবক চৌরাস্তা মসজিদ মার্কেটের পশ্চিম পাশে একটি মোবাইল দোকান করতেন। প্রতিদিন নামাজ পড়তেন চৌরাস্তা জামে মসজিদে। যখন থেকে তার করোনা উপসর্গ, তথা সর্দি, কাশি ও জ্বর দেখা দেয়, তখনো তিনি দিব্যি দোকানে যাতায়াত করেছেন, যেহেতু আল্লাহ্ প্রিয় বান্দা সুতরাং তিনি পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তেন ওই জামে মসজিদে। যখনই তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলো, তখনই খবর পেয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন তার ও তার মায়ের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করলো।
তার রিপোর্ট পজিটিভ আসার দুদিন আগেও দোকান খুলেছেন, তারাবির নামাজ পড়েছেন চৌরাস্তা জামে মসজিদে।
পাশাপাশি সতর্ক করে দিয়ে বলে এলেন, যেন তিনি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য এবং ওই বাড়ির বা ভবনের কেউ বাইরে না যান। অন্তত এই নির্দেশ নমুনার রিপোর্ট আসা পর্যন্ত যেন তারা মানে, তা অনুরোধ করলো স্বাস্থ্য বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তা।
কর্তৃপক্ষের অনুরোধে প্রথম এক-দুইদিন মানলেনও। কিন্তু কয়েকদিন পরই ওই ব্যক্তি বের হয়ে বলে বেড়াতে শুরু করলেন তাকে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানিয়েছে তার শরীরে নাকি করোনা নেগেটিভ এসেছে। এ বলে তিনি দোকান খুলেছেন, চৌরাস্তা জামে মসজিদে নামাজ পড়েছেন। এলাকার লোকজন বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগকে জানালে তারা জানান, ওই যুবকের তথ্য মিথ্যা। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসন এসে পুনরায় ওই যুবককে ঘরে ঢুকিয়ে দেন। স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, যখন ওই যুবককে বাড়িতে থাকার জন্য পুনরায় নির্দেশ দিতে যান। তখন সংক্রমিত ওই যুবক ও তার পরিবারের লোকজন প্রশাসনের সঙ্গে এত বেশি পরিমাণে খারাপ আচরণ করেছে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তবু দায়িত্বের জায়গা থেকে এবং সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে ওই যুবক ও তার পরিবারের সদস্যদের মানসিক সব আঘাত সহ্য করেছিলেন তারা।
৩০ এপ্রিল রাতে ওই যুবককে নিয়ে একজন শিক্ষক আরও এক ভয়ঙ্কর তথ্য দিলেন। ওই যুবক সংক্রমিত অবস্থায় ভুয়া একটি রিপোর্ট বানিয়ে স্থানীয়দের দেখিয়েছেন যে, তার করোনা নেগেটিভ। তার রিপোর্ট পজিটিভ আসার দুদিন আগেও দোকান খুলেছেন, তারাবির নামাজ পড়েছেন চৌরাস্তা জামে মসজিদে।
শুধু তা নয়। যে মার্কেটে ওই যুবক মোবাইল দোকান করতেন, সে মার্কেটের নিচের সব ফলের দোকান খোলা।
যখন থেকে তার শরীরে উপসর্গ দেখা দিয়েছে, তখন থেকে তিনি নিজেকে একা না করে চষে বেড়িয়েছেন পুরো এলাকা। প্রশাসনকে সহযোগিতা না করে উল্টো খারাপ আচরণ করেছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে হয়তো এত দিনে সংক্রামিত করেছেন হাজারো মানুষকে। কিন্তু কেন এমন করেছেন ওই যুবক? কেন তার পরিবার তাকে বাধা দেয়নি! তা খতিয়ে দেখা দরকার প্রশাসনকে।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের স্বার্থে গত ২৮ এপ্রিল সকালে চৌরাস্তাস্থ আব্দুল মালেক উকিল মেডিক্যাল কলেজে গিয়েছিলাম। করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপনের অগ্রগতী বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করতে। পরে সেখান থেকে বের হয়ে দুপুরের দিকে যা্ই বেগমগঞ্জ উপজেলা পরিষদে। সেখানে কাজ শেষ করে আপন নিবাসের সামনে দিয়েই আমি ফিরছিলাম মাইজদী। দেখলাম আপন নিবাস বরাবরই সড়কের ওপর শত শত মানুষ গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিতরণ হচ্ছে। শুধু তা নয়। যে মার্কেটে ওই যুবক মোবাইল দোকান করতেন, সে মার্কেটের নিচের সব ফলের দোকান খোলা। পাশাপাশি অন্য দোকানগুলোও খোলা রয়েছে। পুরো চৌরাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। চলছে যানবাহনও। অথচ পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন। লকডাউন অমান্য করে অবাধে মানুষ ও যানবাহন চললেও তাদের কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি।
তাহলে আগামী এক সপ্তাহ বা দশদিনের মধ্যে বেগমগঞ্জ তথা পুরো নোয়াখালীতে জ্যামিতিক হারে বাড়তে পারে এই ভাইরাসের সংক্রমণ।
ওই যুবকের ২২ তারিখ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। তার আগে তিনি অসুস্থ হয়েছেন। অসুস্থ হওয়ার আগেই তিনি সংক্রমিত হয়েছেন। তার মানে তিনি অসুস্থ হওয়ার আগে-পরে এভাবে অনেকের মাঝেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছেন।
শুধু ওই যুবক বা তার পরিবার নয়। এমন তথ্য গোপন করেছেন চৌমুহনীর ‘গগন সাহা নিত্যানন্দ আড়ৎ’র মালিক রাজন সাহাও। তার দোকানের এক কর্মচারী নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। তথ্য গোপন রেখে তারা তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যান সোনাপুর মহাশ্মশানে। ফলে তার নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি। বর্তমানে ওই ব্যবসায়ীর পরিবার যেমন ঝুঁকিতে রয়েছে, তেমনি ঝুঁকিতে রয়েছে তার দুই কর্মচারী ও তাদের পরিবারও। ওই দুই কর্মচারীর বাড়ি লাকসাম উপজেলায়। চৌমুহনী থেকে সংক্রমিত হয়ে তারা বর্তমানে লাকসাম আছেন। যতদূর জানি, ওই দুই কর্মচারীসহ তাদের পরিবারের মোট ছয় সদস্যও এখন সংক্রমিত। তার মানে ওই ব্যবসায়ীর পরিবার, তার বাড়ি; যে কর্মচারী প্রথম মারা গেলেন, তার পরিবার, যারা এখান থেকে লাকসাম গেলেন, তাদের পরিবারও সংক্রমতি হলো।
অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে, এই রাজন সাহা মূলত সবজির আড়ৎদার। তার আড়তে প্রতিদিন কত লোক এসেছে। বসেছে, চা খেয়েছে। কথা বলেছে তার কর্মচারীদের সঙ্গে। তার সঙ্গে।
যদি চৌরাস্তার দোকানি, ওই মসজিদে যারা নামাজ পড়েছেন—তাদের ও আপন নিবাসের সব বাসিন্দা এবং রাজন সাহার আশপাশের লোকদের করোনা পরীক্ষা না করলে এক সপ্তাহ বা দশদিনের মধ্যেই বেগমগঞ্জ তথা পুরো নোয়াখালীতে জ্যামিতিক হারে বাড়তে পারে এই ভাইরাসের সংক্রমণ।
লেখক: সাংবাদিক
ই-মেইল: omrita07@gmail.com