সমাজে যিনি যে পেশায় নিয়োজিত আছেন, তিনি সেই পেশাকেই সেরা ভেবে বসে থাকেন। কেবল নিজের পেশাকেই শ্রেষ্ঠ যে ভাবেন, তা নয়; অন্য পেশার লোককে প্রায় কটাক্ষ করেন। প্রায় নিজের পেশার সঙ্গে অন্য পেশার তুলনা করতে গিয়ে তারা এই ‘অপরাধ’ করে বসেন।
এই ধরনের তুলনাকে ‘অপরাধ’ বলার সঙ্গত কারণ রয়েছে। যারা নিজের পেশাকে মহৎ আর অন্য পেশাকে তাচ্ছিল্য করেন, তারা কখনোই হয়তো ভেবে দেখেন না, পেশাগত মহত্বের মানদণ্ড কিভাবে নির্ধারিত হয়? কে তাদের বলে দিয়েছে, তার পেশাই মহৎ, অন্য পেশা হীন? একটি নির্দিষ্ট পেশাকে মহৎ বলার সঙ্গে সঙ্গে অন্য পেশাকে হীনভাবে দেখা হয় কি না, সেটিও ভেবে দেখা দরকার। কিন্তু সমাজের কিছু কিছু পেশার লোক নিজের পেশাকে এতটাই মহৎ দাবি করে বসেন যে, তাদের সেই পেশাগত কারণে অন্য যেকোনো পেশার লোকের চেয়ে বেশি সম্মান তারা আশা করেন। প্রত্যাশিত সম্মান না পেলেই ‘জাত গেলো, জাত গেলো’ বলে আকাশ চৌচির করে চিৎকার দেন।
পেশাগত মহত্বের তুলনা করা হয় মূলত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে সেবাবঞ্চিত হলে। কোনো একজন শিক্ষক হয়তো ব্যাংকে গেলেন গ্যাস বিল বা বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার জন্য। তিনি মনে মনে ধরেই নেন, তিনি হলে জাতি গঠনের কারিগর। সুতরাং তার পেশাটি অন্য দশটি পেশার চেয়ে মহৎ। তাই তাকে ব্যাংকে অন্য দশজনের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে বিল দেওয়া বেমানান। তিনি প্রত্যাশা করেন, ব্যাংকের ম্যানেজার এসেই তার কাছ থেকে দ্রুত বিল নিয়ে তাকে লাইনে দাঁড়ানোর ‘বিড়ম্বনা’ থেকে রেহাই দেবেন। ওই সময় তিনি মনে মনে ম্যানেজারকে ছাত্র আর নিজেকে তার দীক্ষাগুরু ভেবেই বসে থাকেন। একইসঙ্গে আশা করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গে যেমন আচরণ করে, ঠিক তেমন আচরণেই করবেন এই ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয় না। সম্ভবও নয়।
যদি গণ্য করা করতে হতো, তাহলে সমাজের সবচেয়ে সৎ-প্রজ্ঞাবান ও নির্মোহ পেশার ব্যক্তি হতেন কৃষক ও নাপিত; মুচি-মেথরও।
সম্ভব যে নয়, এটি তিনি মেনে নিতে পারেন না। আর মেনে নিতে না পারার কারণেই তার মনে হয়, দেশ রসাতলে গেলো। শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশার মানুষকে যে জাতি সম্মান দিতে জানে না, সে জাতির পতন ঠেকানো সম্ভব নয়। তার তখন মনে হতে থাকে—তিনি জ্ঞানী, ব্যাংকের কর্মকর্তারা মূর্খ।
আবার রাস্তায় ট্রাফিক আইন মেনে সবাই চললেও মন্ত্রী-এমপি, লেখক-বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের কেউ কেউ চলতে চান নিজের মর্জিমতো। ওই সময় তারা দাবি করেন, তারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এমনকী তারা একেকজন ভিআইপি। ফলে ‘নিজস্ব সড়কে’ তাদের যানবাহনকে বিশেষ সুবিধা দিতেই হবে। সুবিধা তারা পানও।
তারা সুবিধা না পেলে তখন বিভিন্ন রকমের অভিযোগ তোলেন। অথচ সমাজের আরও দশটি পেশার লোক যখন সেবাবঞ্চিত হয়, তখন এই শিক্ষক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদরা কোনো প্রতিবাদ করেন না।
এই শিক্ষক, মন্ত্রী, এমপি ও সাংবাদিকের মতো সমাজে আরও অনেক পেশার লোক আছেন, যারা তাদের প্রত্যাশিত সেবা না পেলে তখন নিজের পেশাকে অন্য পেশার সঙ্গে তুলনা করেন। একইসঙ্গে এও বলতে ভোলেন না যে, তিনি যদি শিক্ষক কিংবা সাংবাদিক না হয়ে একজন পুলিশ কনস্টেবল কিংবা উর্দিপরা চৌকিদারও হতেন, তাহলে সবাই তাকে সমীহ করতো। ভয় পেতো। কেউ যখন নিজের পেশাগত পরিচয়কে বেশি মহৎ প্রমাণ করার জন্য উর্দিপরা কোনো পেশাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনেন, তখন কি ভেবে দেখেন, ওই পেশাকে তিনি খাটো করছেন?
রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তিনি কি অন্য পেশার লোককে খাটো করে দেখতে পারেন? নিজের পেশা নিয়ে এত অহং কিভাবে জন্মায় তার মনে? মর্যাদা নির্ণীত হয় কিসের ভিত্তিতে? যেসব মানদণ্ডে পেশাগত মর্যাদা নির্ণীত হয়, তার মধ্যে সততা, প্রজ্ঞা ও নির্মোহ বৈশিষ্ট্যকে হয়তো গণ্য করা হয় না। যদি গণ্য করা করতে হতো, তাহলে সমাজের সবচেয়ে সৎ-প্রজ্ঞাবান ও নির্মোহ পেশার ব্যক্তি হতেন কৃষক ও নাপিত; মুচি-মেথরও।
বাকি পেশাজীবীরা অর্থাৎ শিক্ষক-আমলা-সাংবাদিক-আইনজীবী-রাজনীতিবিদ-পুলিশ সদস্যরা কেবল উপকারভোগীই। তারা কেউই মানবজাতির বড় শিক্ষক নন; উপকারী কিংবা বন্ধুত্ব তো ননই।
যদি কোথাও কাউকে বিশেষ প্রাধিকার দিতেই হয়, তাহলে এই কৃষক, এই নাপিত, এই মুচি এই মেথারকেই দেওয়া উচিত। বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসবিল দেওয়ার সময় বিশেষ সুযোগ তাদেরই দেওয়া উচিত। যেখানে লাইন ধরে কোনো সেবা নিতে হয়, সেখানে এই দুই পেশার লোকেরই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। আর কারও নয়। কৃষক পুরো সমাজের খাদপণ্যের জোগান দেন, বিনিময়ে কোনো উপঢৌকন কিংবা ঘুষ কিংবা ন্যূনতম সালামটুকুও প্রত্যাশা করেন না। নাপিত চাইলেই তার দোকানে ক্ষৌরকর্মের জন্যে যে ধনী লোকটি যায়, তার গলায় ক্ষুর চেপে ধরে তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারতেন। মুচিও চাইলে পেরেক ভেতরে রেখে জুতা পরিয়ে দিতে পারতেন, মেথরও কম পারিশ্রমিক পেলে মলভাণ্ড থেকে মল এনে সুশীলদের ঘরের দরোজা রেখে প্রাপ্য আদায় করতে পারতেন। যেভাবে অফিসের লোক ফাইল আটকে রেখে ঘুষ আদায় করে নেয়। কিন্তু এই কৃষক-নাপতি-মেথর-মুচি সেই অধর্মের কাজটি করেন না। পরন্তু সমাজের ঘুষখোর আমলা, লম্পট শিক্ষক, ধান্দাবাজ সাংবাদিক, অসৎ পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখলেই তারা মাথা নুয়ে সালাম করেন। অথচ সালাম তাদেরই প্রাপ্য।
এই কৃষক-নাপিত-মুচি-মেথর যত বড় সৎ, ততটা নিজেদের মর্যাদার বিষয়ে সচেতন নন। সচেতন হলে তারাও ফেসবুকে কিংবা পত্রিকায় কলাম লিখে সেই সম্মান দাবি করতে পারতেন। তারাও বলতে পারতেন, আজ কৃষক-নাপিত-মুচি কিংবা মেথর না হয়ে স্কুলের শিক্ষক কিংবা সাংবাদিক হলে লোকে সালাম দিতো। কৃষক-নাপিত-মুচি-মেথর হওয়ায় কেউ সালাম দিলো না। কিন্তু এই কৃষক-নাপিত-মুচি-মেথররা কোনোদিন এমন কথা বলবেন না। কেন বলবেন না? বলবেন না, কারণ তারা হৃদয়বৃত্তি-সততা-প্রজ্ঞার মানদণ্ডে তথাকথিত সম্ভ্রান্ত পেশার মহৎদের চেয়েও মহৎ। স্বর্গের দেবতার চেয়েও বড় দেবতা। তাদের জোগানো অন্নে সমাজ বাঁচে, তাদের সেবায় মানুষ নিজেকে সাজায়।
অতএব, হে স্বঘোষিত মহান সব পেশার ব্যক্তিগণ, নিজের পেশাকে বড় করে না দেখে আগে কৃষক-নাপিত-মুচি-মেথরের দিকে তাকান। মানবসেবার মহানব্রত তাদের কাছ থেকেই শিখুন। সমাজের সবচেয়ে বড় শিক্ষক এই চারজনই। বাকি পেশাজীবীরা অর্থাৎ শিক্ষক-আমলা-সাংবাদিক-আইনজীবী-রাজনীতিবিদ-পুলিশ সদস্যরা কেবল উপকারভোগীই। তারা কেউই মানবজাতির বড় শিক্ষক নন; উপকারী কিংবা বন্ধুত্ব তো ননই।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী
ইমেইল: hoque.mdnurul@yahoo.com