[পর্ব-২]
দেখতে দেখতে শীতকাল এসে গেলো। ততদিনে নদী ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মাঝরাতে ছমির হাটফেরত হাটুরেরা চরলক্ষ্মীর দিকে যাচ্ছে। তাদের পায়ের ঘর্ষণ লেগে নদীর লোনা জলে আলো জ্বলে উঠছে। প্রথম প্রথম ভয় পেতাম। এতরাতে বুঝি জিনেরা নদীতে চলাচল করে। কিন্তু কেউ সেই ভুল ভাঙিয়ে দেয়নি। আরও ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, রাতে বাইরে না তাকাতে। আমরাও আর তাকাতাম না। কেবল কান পেতে জলের শব্দ আর হাটুরেদের গান শুনতাম। আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি…।
আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে ইউনিয়ন বোর্ডের নতুন রাস্তা হচ্ছে। মাটি কাটার ফলে রাস্তার দুই পাশে তৈরি হচ্ছে খাল। আমরা সেই খালে দশবেঁধে নেমে মার্বেল-ডাংগুলি খেলি। কখনো বা বড় বেগুন কিংবা খড়ের বল বানিয়ে বল খেলি। কখনো বা হাডুডু। কখনো বা সিগারের প্যাকেট কেটে দুই পাশে বড় দুই অংশ নিয়ে কয়েন ছুড়ে ছোঁয়া-ছুঁয়ি খেলা। স্টার সিগারেটের একপাশ ১০০টাকার সমমান, আর সিজার সিগারেটের এক পাশ ৫০০ টাকা অন্যপাশ হাজার টাকার সমমান ধরা হতো। তবে, অন্য বন্ধুদের মতো আমি সবসময় এই সব খেলায় অংশ নিতে পারতাম না। কারণ সকালে মক্তবে যাওয়া, মক্তব থেকে ফিরে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরে গরু নিয়ে মাঠে যাওয়া। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফেরা, এই ছিল নিত্য রুটিন। এর বাইরে যাওয়া ঝুঁকির ছিল।
আর যারটার গেজানোতে (কোপানো বা আঘাতে) অন্য লাটিম ফেটে যায়, তারটাই বিজয়ী হয়। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলা চলে। সময় গড়িয়ে যায়। খেলা শেষ হলে আমি বাড়ি ফিরি।
এছাড়া, আমার বাবা প্রায় বাড়িতে থাকতেন না। তাই আমাদের দুই ভাইকে মক্তব-স্কুলের বাইরের সময়টুকু সারাক্ষণই বাড়িতে থাকতে হতো। বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছিলেন বোহেমিয়ান। ব্যবসায় উপলক্ষে চলে যেতেন জেলার বাইরে। বাড়িতে মা থাকতেন একা। ঠিক একা নয়, সঙ্গে ছিলাম আমরা দুভাই। মাঝে-মাঝে মফিজ মামা আসতেন। মামা আমার বয়সী হলে কী হবে, জ্ঞানগম্যিতে ছিলেন সবজান্তা। কথা বলতেন চোখে-মুখে। যেকোনো বয়সের মানুষকে কথার জাদুতে মুগ্ধ করতে পারতেন। তার ছিল পকেটভর্তি মার্বেল আর হাতের মুঠোয় লাটিম। মার্বেল আর লাটিম খেলায় দর্শকদের তাক লাগানোয় তার জুড়ি ছিল না আমাদের তল্লাটে।
তো মফিজ মামার লাটিম দেখে আমারও কেনার শখ হলো। কিন্তু লাটিম কোথায় পাওয়া যাবে, তা জানা নেই আমার। মামাও বলেন না। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেখি, গ্রামের রাখালরা লাটিম খেলছে। একেকজনেরটা একেক রঙের। সেই লাটিম খেলারও কত কায়দা-কানুন। কেউ হাতটা নিচ থেকে পেছন দিকে ঘুরিয়ে এনে মাথার ওপর দিয়ে সামনের দিকে ছুড়ে মারে। কেউ হাতটা নিচু করে সামনের দিকে কেবল আলতো করে ছেড়ে দেয়। অমনি ভোঁ-ভোঁ ঘূর্ণন। কখনো-কখনো একজনের লাটিমের ওপর আরেকজনেরটা এসে পড়ে। যারটা যত বেশি সময় ধরে ঘোরে সে তত বেশি পয়েন্ট পায়। আর যারটার গেজানোতে (কোপানো বা আঘাতে) অন্য লাটিম ফেটে যায়, তারটাই বিজয়ী হয়। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলা চলে। সময় গড়িয়ে যায়। খেলা শেষ হলে আমি বাড়ি ফিরি।
বাড়িতে ঢুকেই দেখি সামনের রুমে মফিজ মামা। তার দুহাতে দুই রঙিন লাটিম। এর মধ্য থেকে একটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোর। তখন থেকে ওই লাটিম হয়ে গেলো আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে রাখি, স্কুলে গেলে পকেটে। বাড়িতে বাবা নেই। তাই অপার স্বাধীনতা। বাড়ির পাশে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা। ওই রাস্তার পাশে বিকালবেলা আমার বয়সী সব ছেলে জড়ো হয়। কেউ খেলে হাডুডু, কেউ ডাংগুলি, কেউ মার্বেল আর কেউ লাটিম। সেদিন আমিও গেলাম লাটিম নিয়ে।
ঠিক যেখানটায় আমার লাটিমটা এতক্ষণ ঘুরছিল, সেখানে নিরঙ্কুশ বিজয়ের নিনাদ তুলে ঘুরছে মফিজ মামার লাটিম। ওই ঘূর্ণন যেন অনন্তকাল ধরে চলছিল।
একেক দলে ছয়-সাতজন করে খেলছে। ঢুকে গেলাম একদলে। বেল্লাপারের বৃত্তের ভেতর ঘুরছে তিন-চারটা লাটিম। আরও দু-তিনটা লাটিম ওই লাটিমগুলোকে গেজানোর জন্য একের পর এক নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আমার লাটিমটা হাতে নিয়ে লেত্তি পেঁচিয়ে সাজালাম। ডান হাতটা নিচের দিক থেকে ঘুরে নিলাম পেছনে। এরপর পেছন দিক থেকে মাথার ওপর দিয়ে হাত ঘুরিয়ে এনে সজোরে ছুড়ে দিলাম ঘূর্ণায়মান লাটিমগুলোর ওপর। একসঙ্গে দু-দুটো লাটিম বৃত্ত পার হয়ে গেলো। আমার লাটিম তখন বিশ্বজয়ী নেপোলিয়ন। ঘুরছে ভোঁ-ভোঁ। কাউকেই পরোয়া করে না। একে-একে জয় করে নিলাম চার-চারটে লাটিম। সবাই হৈ-হৈ করে উঠলো। সবার হাততালিতে কানে তালা লেগে যাওয়ার দশা।
এত হাততালির মধ্যেও যারা নির্বিকার ছিলেন, তাদের দলে মফিজ মামাও একজন। আমি তো অবাক। আমার জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বিস্ময়, অপেক্ষা করছিল বেদনাও। মফিজ মামা লেত্তিটা লাটিমে পেঁচালেন, খুব ধীরে। প্রথমে কাঁটাতারের পেরেকের তৈরি গেজের দিকে লেত্তির এক প্রান্ত জড়ালেন, এরপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গেজের সরু প্রান্ত থেকে আস্তে-আস্তে কাঠের লাটিমের অর্ধাংশ পর্যন্ত জড়িয়ে নিলেন। ডান হাতটা নিচু করে সামনের দিকে খুব আলতো করে বাড়ালেন। লাটিমটা ভূমি স্পর্শ করতেই লেত্তিতে মারলেন একটা হেঁচকা টান। শুরু হলো লাটিমের ভোঁ-ভোঁ ঘূর্ণন। মামা এবার লেত্তির দুই প্রান্ত দুই হাতে ধরে লাটিমের দিকে ছুড়ে মারলেন। তারপর ছোঁ মেরে তুলে আনলেন হাতের তালুতে। লাটিমটা ভূমিতে যেমন ঘুরছিল, মামার হাতের তালুতেও তেমন ঘুরলো। একসময় থামলো লাটিমের ঘূর্ণন।
এদিকে, অন্যদের লাটিমগুলো যথারীতি বেল্লাপারের বৃত্তে ঘুরছিল। সব লাটিমের ঘূর্ণন থেমে গেছে, ঘুরছে কেবল আমারটা। কোনও রকম পূর্বঘোষণা না-দিয়েই মফিজ মামার লাটিম ভোঁ করে এসে পড়লো আমার লাটিমের ওপর। চোখের পলকে ঘটে গেলো এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বৃত্তের বাইরে এসে পড়লো আমার লাটিমের ৩ টুকরো। ঠিক যেখানটায় আমার লাটিমটা এতক্ষণ ঘুরছিল, সেখানে নিরঙ্কুশ বিজয়ের নিনাদ তুলে ঘুরছে মফিজ মামার লাটিম। ওই ঘূর্ণন যেন অনন্তকাল ধরে চলছিল।
পড়ুন আগের পর্ব:জীবনের যতিচিহ্নগুলো-১
চলছে…