কলাম

সময় বয়ে যায়


পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। আমরা পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ। আড়ম্বরহীন ছোটখাটো বিদায় অনুষ্ঠান। ম্যানেজিং কমিটির তিন সদস্য অতিথি। নুর আলম মুন্সী দোয়া করবেন। তিনি একটা গানও গাইলেন, ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনুগো আঁখি খোলো।’ অনুষ্ঠান শেষে সার্টিফিকেট বিতরণ হচ্ছিল ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে। প্রথম জনের বয়স দেওয়া হলো দশ বছর। পরের জনের বয়স কত দেবেন জানতে চাইলেন হেড স্যার। জ্যেষ্ঠতার মর্যাদা পেতে একবছর বাড়িয়ে দিতে দাবি জানালো সে। স্যার একমাস মঞ্জুর করলেন। পেছনের দিকে বয়স ক্রমাগত একমাস করে বেড়ে চলতে লাগলো। লাইনের একেবারে শেষের দিকে ছিলাম। অতএব বুঝতেই পারছেন!

গোলাপি রঙের পাতলা কাগজে লেখা জীবনের প্রথম অর্জনটি অতি যত্নে বুকের সঙ্গে আগলে ধরে বাড়ি চলে গেলাম। কিন্তু সার্টিফিকেটে আমার নামের দ বর্ণের সঙ্গে হ্রস্ব উ কার নামক লেজটি যে বাদ পড়ে গেছে, তা অতি উত্তেজনার বশে খেয়াল করিনি। পরের দিন হেড স্যারের শরাণাপন্ন হলে তিনি জানালেন, আমার নামের এ অংশের বাংলা হচ্ছে সিংহ। আর এ লেজ বাদ পড়ার জন্য অর্থের কোনো হেরফের হয়নি। সিংহ অক্ষত আছে, আহত বা নিহত হয়নি। এতেই আশ্বস্ত হলাম। তাই কখনো এ লেজটা নিজে নিজে লাগিয়ে দেওয়ার কথাও ভাবিনি। আজও সেভাবেই আছে। অবশ্য স্যারের নামের দ বর্ণটাও হ্রস্ব উ কার ছাড়াই উচ্চারিত হতো। শ্রদ্ধেয় ছায়দল হক স্যারের কথা বলছি।

হাইস্কুলে (তখনো চরক্লার্ক জুনিয়র হাই স্কুল) ভর্তির বিষয়টি খালু স্যারের (শ্রদ্ধেয় নুরনবী স্যার) সঙ্গে আলাপ করে বাবা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। পরের দিন ভর্তি। সকালের সোনালি সূর্যটি উঁকি দেওয়ার আগেই সে এক দারুন উত্তেজনায় ঘুম ভাঙলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সহপাঠী সেলিম হাজির। মাথায় চুইয়ে চুইয়ে নারিকেল তেল বেয়ে বেয়ে পড়ছে, গলায় ধবধবে টেলকাম পাউডার। এটা তৎকালীন ফ্যাশন।

 এ আসরের মধ্যমনি মোহাম্মদ নূরুল হক। আমরা যখন রবীন্দ্র, নজরুল, শরৎ বাবুতে হামাগুড়ি দিচ্ছি, তখন তার বিচরণ ওপার বাংলায়। সুনীল, বুদ্ধদেবদের নিয়ে তার নিবিড় চর্চা।

ফসি মামা, মোহাম্মদ নূরুল হক, আনোয়ার, বেলাল, সাইফুল, শফিক, বাশার, মায়া, রহিমা আলেয়া (দিদার আগেই চট্টগ্রাম চলে যায়) সারিবদ্ধভাবে চলছি ‘ধুর’ পড়া (পায়ে হাঁটার বিশেষ পথ) সদ্য ধান কাটা ক্ষেতের মাঝ দিয়ে। অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল হাতছানি দেওয়া স্কুলের তেতলা দালানটি। এটিই আমাদের স্বপ্নের বাতিঘর, জীবনের সেরা সময় কাটানোর নির্ভেজাল স্বপ্ন সৈকত।

প্রথম ক্লাসে এলেন হুজুর স্যার (শ্রদ্ধেয় মাওলানা নুরুল্যাহ)। পরিচয় পর্ব শেষে কিছু উপদেশ বাণী শোনালেন। আজও সেসব পথের পাথেয়। যথাক্রমে ব্রজলাল স্যার, সন্তোষ স্যার, নুরনবী স্যার এলেন। আর বুঝিয়ে দিলেন প্রাইমারি আর হাইস্কুল এক জিনিস নয়। সবার পরে এলেন মধ্যবয়সী রাশভারী এক ভদ্রলোক। মাথায় নিপুণ সিঁথি কাটা, নিচু করে পরা লুঙ্গিটা বাম হাতে ধরা, ডান হাতে মিটার খানেক সাইজের একটি শাসন যন্ত্র (বেত)। হ্যাঁ, প্রথম ক্লাসেই বেত! তিনিই আমাদের অংকের মহাপুরুষ জাফরুল্লাহ স্যার। গৌরচন্দ্রিকা করলেন না। বিজ্ঞানের বই খুললেন। ‘আলো এক প্রকার শক্তি’র পক্ষে যুক্তি দিয়ে চললেন। পাকা দালানে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসা শব্দগুলোও সাক্ষ্য দিচ্ছিল স্যারের পক্ষে। আমাদের স্যারদের এভারেস্ট সম যোগ্যতা ছিল কি না, এই নিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু শিক্ষার্থীকে ভালোবাসায় আটলান্টিক সম হৃদয় নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পাবেন না।

প্রতি বার্ষিক পরীক্ষার পর ছুটির দিনগুলোয় পরবর্তী ক্লাসের অঙ্কের বইটা একবার শেষ করে নেওয়া ছিল আমার প্রিয় সখের একটি। তবে পাটিগণিতের তিন ছিদ্র বিশিষ্ট চৌবাচ্চার খালি-ভরাট কংবা বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠানামার জটিল হিসাব কষতে গিয়ে যখন এ অনুর্বর ঘিলুটা উত্তপ্ত হয়ে উঠতো, ফসিমামার দ্বারস্থ হতাম। দু’জনের নিবিড় গবেষণায় হাবিজাবি গোছের একটা সমাধান বেরিয়ে আসতোই। মাঝে মাঝে বদি মামার (অধ্যাপক বদিউল আলম) শরণাপন্ন না হয়ে আর উপায় থাকতো না। তার চমৎকার হাতের হস্তাক্ষর নকল করার ব্যর্থ চেষ্টাও করতাম আমরা।

বাংলার গদ্যপদ্য খুব একটা পড়া লাগতো না। স্কুল পথের মধ্যবিরতিতে মৌলবী বাড়ির (মৌলবী ওবায়দুল হক) বটতলায় গল্পের ছলে শেখা হয়ে যেতো ক্লাসের আগে আগেই। এ আসরের মধ্যমনি মোহাম্মদ নূরুল হক। আমরা যখন রবীন্দ্র, নজরুল, শরৎ বাবুতে হামাগুড়ি দিচ্ছি, তখন তার বিচরণ ওপার বাংলায়। সুনীল, বুদ্ধদেবদের নিয়ে তার নিবিড় চর্চা। তার পড়ার ঘর (মামা কালাম নেতার কাছারি)ছিল আমাদের পড়াশোনা আর আড্ডার এক ধূম্রহীন কফি হাউজ। বিভিন্ন রকমের বই থাকতো এখানে। ওই সময়ে বই সংগ্রহ করে অর্থ অপচয় করার মতো কাজ ছিল নিতান্তই বিলাসিতা। জনাব আবুল কালাম আজাদ এবং শেখ ফরিদ (আল ফরিদ) ছিলেন আমার দেখা এ অঞ্চলের সবচেয়ে সৌখিন মানুষ। শুনেছি স্কুলটির অচলাবস্থা নিরসনেও তাদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।

মরহুম ছোলেমান চেয়ারম্যান ও মোশাররফ মেম্বারের বদন্যতায় বাড়ির দরজার কাঁচা রাস্তাটি যখন স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তখন স্কুল পথের রুট পরিবর্তন হলো। নতুন সহযাত্রী ইউসুফ আংকেল। পথে নিজাম শাহাদাৎসহ আরও কয়জন যোগ দিতো। নিজাম বয়স এবং বুদ্ধি দু’টিতেই আমাদের চেয়ে কিছুটা আগুয়ান ছিল। ইংরেজি বলতো বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। আমরা যখন ভার্ব (Verb)-এর শেষে এস বা ই.এস নিয়ে কনফিউজড, তখনো ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গিয়েছে কিংবা গাইটি বুড়া বিয়ানও শেষ’ ইত্যাদি জাতের ইংরেজিগুলো থাকতো ওর জিহ্বায় ডগায়। সিদ্দিক মিয়ার দোকানের সামনের খেজুর গুড়ির সাঁকোটি ভেঙে যেতো মাঝে মাঝে। মেরামতের আগ পর্যন্ত লুঙ্গি খানা একটু উঁচু করে ধরে কোনোভাবে খালটি পার হয়ে যেতাম আমরা। কখনো আবার পানির পরিমাণ এত বেড়ে যেতো যে, দুই-একজন খুদে সতীর্থের লুঙ্গিগুলোও প্রায় বিপদ সীমার কাছাকাছি পৌঁছে যেতো। লুঙ্গিগুলো ভিজে যেতো কেবল লাজুক ছেলেদের। না জনাব, তখনো প্যান্টের ব্যবহার এতটা সমাদৃত হয়নি।

মাঝে মাঝে সে আড্ডা এত দীর্ঘয়ায়িত হতো যে চারপাশের দ্বীপের মতো বাড়িগুলোতে কেরোসিন শিখা জ্বলে উঠতো।

রিপন, বেলায়েত, জাহাঙ্গীর, নুর হোসেনদের সঙ্গে, জিকো, আলো ভাইয়েরা যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত ফুটবলে আমরা ততটা অপ্রতিরোধ্য ছিলাম না। তাই বলে খেলার মাঠে কেউ ল্যাং মেরে পার পেয়ে যাবে এমটাও ভাবার কারণ নেই। ভুলে যাবেন না, আমাদের একজন নুরুদ্দিন ভাইও ছিলেন! ছুটির পরে ব্রজলাল স্যারের তাড়া খাওয়ার আগ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন অধ্যাবসায় চালিয়ে যেতাম ফুটবল নামক এ শিল্পটির। দুপুরের খাওয়াটা ছিল খুব গৌণ বিষয়। কর্দমাক্ত দেহ নিয়ে টুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম মাঠের উত্তর পাশের ডোবা সদৃশ পুকুটাতে। তারপর লুঙ্গিখানা গলা পর্যন্ত উঁচু করে মেলে শুকাতে শুকাতে একদল পেঙ্গুইনের মতো ছুটে চলতাম বাড়ির পানে। বাড়িতে কেউ আন্দাজই করতে পারতো না যে, এই দেরির বিষটি জাফরুল্লাহ স্যারের লম্বা ক্লাসের কারণে হয়নি।

সংগীত-ললিতকলায়ও আমরা একেবারে গণনার অযোগ্য ছিলাম না। নুর আলম, নুরনবীদের কত রঙবেরঙের গান! ‘মুর্শিদের নামটি ধরো… কিংবা বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথায় পড়শি বসত করে’ আজও কানে বাজে কোনো এক একাকী বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়। কাদের, মিজান, হুদারা ক্লাস পরিবর্তন করে ছিল বটে, কিন্তু মতের ভিন্নতা তৈরি হয়নি কোনোদিন।

ফসি মামাদের সঙ্গে পথের বিরহ বেশি দিন টেকেনি। সমঝোতা হয়ে গেলো। দুই গ্রুপ মধ্যপথ আবিষ্কার করে নিলাম। সে মধ্যপথের শেষ সীমায় ছিল বিখ্যাত মৌলবী বাড়ির বটতলা। আড্ডা চলতো সন্ধ্যা অবধি। বিজ্ঞান, সাহিত্য ধর্মচর্চার কী বাকি থাকতো ওই আসরে! মাঝে মাঝে সে আড্ডা এত দীর্ঘয়ায়িত হতো যে চারপাশের দ্বীপের মতো বাড়িগুলোতে কেরোসিন শিখা জ্বলে উঠতো। কখনো বা দূর থেকে ভেসে আসতো কচি কণ্ঠের সে মর্মস্পর্শী পাঠচর্চা ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই”, কিংবা সন্ধ্যা অবধি ঘরে না ফেরা ছাগলগুলোকে ঘরে ফেরাতে সে মায়াবী আকুতি ‘আককুরর…কুররর’।

সৃজনশীল নামক কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে কিছুদিন কাজ করতে হয়েছে আমাকে। নিজের চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ প্রশিক্ষণার্থীদের সামনে এ সৃজনশীলতা নিয়ে কথা বলতে স্বস্তি পাই কী করে? নিজেই তো এতে পরিতৃপ্ত ছিলাম না। আমার কাছে সৃজনশীলতা হচ্ছে ওই মৌলবী বাড়ির বটতলা।

বিভ্রাটটা ঘটে গেলো অষ্টম শ্রেণীর পর (১৯৯৩)। আমাদের নাকি সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না। প্রায় চল্লিশ হাজার অধিবাসীর এই বৃহৎ ইউনিয়নজুড়ে কোনো হাইস্কুল নেই। তাই এখানে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার জোর দাবি উঠলো। সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এনামুল হক (বর্তমানে প্রয়াত) বিষয়টি নিয়ে ভিষণ চিন্তিত। এটা তার নির্বাচনি ওয়াদাও। সমাবেশের আয়োজন হলো। স্কুলের দক্ষিণ পাশে বলই গাছে (ছোট ছোট বলের মতো অখাদ্য ফলবতী এক জাতের কাঠ গাছ) ঝুলানো মাইক্রোফোনে ভেসে এলো, ‘হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হলে আমি এনাম লুটিয়ে পড়বো।’ মরহুম মাস্টার দিদ্দিক উল্যাহ, নানা খালেকুজ্জামান মিয়া, খালু নুর আমিন মেম্বার, মরহুম খুরশিদ মেম্বার প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও বক্তব্য রাখলেন। মাস্টার আহছান উল্লাহ (মেম্বার)-এর অসাধারণ বক্তব্যে উপস্থিত অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন।

নিজেদের স্কুলটি হাইস্কুল হবে, এটা ভাবতে যেমন ভালো লেগেছিল, তেমনি শঙ্কা জেগে উঠলো ভবিষ্যৎ নিয়েও। কারণ মাত্র দু’বছর আগে একবার এ উদ্যোগ ব্যর্থ হলে ভীষণ সংকটে পড়েন পূর্বসূরিরা। শেষে পাশের ইউনিয়নের রামগোবিন্দ স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে কোনোভাবে রেহাই পান তারা। ঘরপোড়া গরুর সিঁদুর রাঙা মেঘ দেখার মতো সবকিছুতেই ভয় আর সংশয় গ্রাস করতে লাগলো আমাদের। স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক চলতে লাগলো। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আনার জন্য আমরা জোর দাবি জানালাম। কর্তৃপক্ষ সব দাবি মেনে নিলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্বেও বিএসসি শিক্ষক পাওয়া গেলো না। আর বিএসসি নামক সোনার হরিণ ছাড়া সায়েন্সের অনুমোদনও পাওয়া যাবে না। রহমত উল্যাহ স্যার কিছুদিন প্রক্সি দিয়ে গেলেও শেষে বিজ্ঞান বিভাগ শিক্ষক শূন্য হয়ে গেলো।

পায়ে হেঁটে প্রায় অর্ধশত কিলো ভুলভাল পথ পাড়ি দিয়ে আমরা কোম্পানীগঞ্জ ইলিয়াসের লজিং বাড়িতে আশ্রয় নিলাম।

আমরা আন্দোলনে গেলাম। জরুরি সভা ডাকা হলো। আমাদের মানবিক বিভাগে (তৎকালীন সমাজবিজ্ঞান বিভাগ) পড়ার পরামর্শ দিলেন কেউ কেউ। অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলতে চাইলাম না আমরা। এিই নিয়ে ছিদ্দিক উল্যাহ মাস্টারের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়লো মোহাম্মদ নূরুল হক। সভায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। ক্ষুব্ধ হলেন খুরশিদ আলম মেম্বার। তিনি বললেন, এই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে আমাদের বিশ জনকে কোরবানি দেবেন তারা। জিল্লু (তার ভাগ্নে) প্রতিবাদ জানালো প্রথমে। সাফ জানিয়ে দিলো, ‘আমরা এই কোরবানির বকরি হতে রাজি নই।’ নবী আলমের ওপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ হচ্ছিল। কিন্তু সে ভাঙার লোক, মচকানোর নয়।

মোহাম্মদ নূরুল হকের পড়ার ঘরে (কালাম মামার কাছারি) রাত ন’টার গোপন মিটিংয়ে পরিকল্পনা চূড়ান্ত। আমরা নদী পথে কোম্পানীগঞ্জ চলে যাবো। রাত পোহাবার আগে কাউকে না জানিয়ে আমরা বেরিয়ে গেলাম। পূর্বপরিকল্পনা মতো প্রথম ধাপে যাবো আমরা চার জন। ফসি মামা, মোহাম্মদ নূরুল হক, বেলাল ও আমি। জোয়ার ভাটার হিসাব করে যাত্রা শুরু করলাম। মাঝ নদীতে জলের গভীরতা কিছুটা বেশি। হাতে হাত ধরে মানব চেইন তৈরি করে নেমে গেলাম। নোনাজলের উত্তাল ঢেউ আর পায়ের নিচের খসে যাওয়া বালির বিরূপ আচরণে মধ্যপথে বেলাল আর নূরুল হককে প্রায় হারাতে বসলেও কুলে এসে দেখি সংখ্যাটা কমেনি, চার জন ঠিকই আছে। পায়ে হেঁটে প্রায় অর্ধশত কিলো ভুলভাল পথ পাড়ি দিয়ে আমরা কোম্পানীগঞ্জ ইলিয়াসের লজিং বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। উল্লেখ্য, ইলিয়াস, আনোয়ার ও সোহেল আগেই চলে গিয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়।

সকালবেলা বাংলাবাজার স্কুলে গিয়ে বুঝলাম গোপাল একা চলে না, সঙ্গে কপালও নিয়ে চলে। রেজিস্ট্রেশনের সময় নাকি শেষ! নাসির জুনিয়র নামক একটি নবপ্রতিষ্ঠিত স্কুল আমাদের রেজিস্ট্রেশনের নিশ্চয়তা দিলো। আদর আপ্যায়নেও মুগ্ধ করলো আমাদের। কিন্তু সেটিও একটি নতুন স্কুল হওয়ায় আমরা সংশয়মুক্ত হতে পারলাম না। এদিকে মায়ের আঁচলে থেকে বেড়ে ওঠা এই কিশোরদের তখনো বেশিদিন বাড়ির বাইরে থাকার অভ্যেস গড়ে ওঠেনি। ভাবলাম বাড়ি থেকে একটু ঢুঁ মেরে আসি। ভর্তির বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেব।

বাড়ি এসে দেখি সে এক লঙ্কাকাণ্ড! মা এ কয়দিন প্রায় না খেয়ে আছেন। বাবা অভিমানে আমার সঙ্গে কথা বললেন না। তাঁর মুখের দিকে তাকানোর সাহস পেলাম না। মাথা নিচু করে বললাম, বাবা আমি এখানে থাকবো না, আমি সায়েন্সে পড়তে চাই। বাবার পাল্টা প্রশ্ন, আর্টসে পড়ে কি কেউ কখনো মানুষ হয়নি? মাথায় হাত রেখে বললেন, শিক্ষকদের অবাধ্য হয়ো না। তোমাদের প্রতি এলাকার দাবি আছে। আমি চাই না, এতগুলো মানুষকে অবজ্ঞা করে তুমি বড় কিছু হও। ধনু (ফছিমামা) ও নূরুল হকের সঙ্গে আরেকবার কথা বলে দেখো। ওরা মেধাবী মানুষ।

আমার হাতযুগল বাবার কদম মোবারকে। বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ পৃষ্ঠদেশে দু’ফোটা উষ্ণ জল অনুভব করলাম। এদিকে সহযাত্রীরা আমার দিকে চেয়ে আছে। প্রায় দু’কিলোর খরস্রোতা নদীর কাছে হার না মানলেও শুভ্রকেশী ষাটোর্ধ্ব বাবার এই অশ্রুজলকে অতিক্রম করার শক্তি আমার ছিল না। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আমি আর্টসেই পড়বো।

পড়ার রুমে গিয়ে দেখি খাকি কাগজে বাঁধাই করা বিজ্ঞানের বইগুলো কী সুন্দর করে শেল্ফে সাজানো রয়েছে! বুঝলাম, এই মায়াবী বইগুলো আমার প্রতিজ্ঞার পথে অন্তরায় হতে পারে। বড্ড জেদ চেপে গেলো মাথায়। গোয়াল ঘরের ওপারে নর্দমার জলে শুধু বইগুলো ভাসিয়ে দিলাম না, ভাসিয়ে দিলাম শৈশব দেখা জীবনের প্রথম স্বপ্নগুলোও।

কিন্তু সময় তো আর বাবাদের জন্য থেমে থা কেনা। সময় বয়ে যায়।

আমার সঙ্গে অনেকেই গ্রুপ পরিবর্তন করলো। কিন্তু ফসি মামা বিজ্ঞান ছাড়া পড়বেন না। শৈশব থেকে বিজ্ঞানের প্রতি তার অসম্ভব অনুরাগ। দৃঢ়চেতা এই বিজ্ঞানমনা শেষে এক ক্লাস পেছনে গিয়ে খাসের হাঁট স্কুলে ভর্তি হন। স্কুল ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন তার বিরহব্যাথা যারা দেখেছে, তারা কোনোদিন তাকে স্কুল ছেড়ে যাওয়ার অপরাধে অপরাধী করবে না নিশ্চয়।

কিছুদিন পর (দশম শ্রেণীর বছর) জানতে পারলাম, বিজ্ঞান বিভাগ অনুমোদন পেয়েছে। একজন বিএসসি শিক্ষকও পাওয়া গেছে (শ্রদ্ধেয় নজরুল স্যার)। কিন্তু ততদিনে আবেগের নদে ভাটা পড়ে গেছে। আমাদের কেউ আর বিজ্ঞানে পড়তে রাজি হয়নি। নবম শ্রেণী থেকে একজনকে (মরহুম ছানা উল্যাহ সেলিম) এনে বিজ্ঞানে ভর্তি করানো হয়েছে। সে-ই এই স্কুলের প্রথম বিজ্ঞানের ছাত্র।

শুরু করলাম অর্থনীতি, ইতিহাস ও হিসাববিজ্ঞান নিয়ে নতুন পদযাত্রা, ডানাভাঙা স্বপ্নরথে উড্ডয়নের দ্বিতীয় প্রচষ্টা। কিন্তু ইতিহাস, অর্থনীতি কোনোভাবে কাটিয়ে উঠলেও দেরিতে শুরু করায় হিসাববিজ্ঞান নিয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল। সহপাঠীদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলাম না ঠিকমতো। ক্লাসে প্রায় নির্লিপ্ত থাকতাম। এগিয়ে এলেন বি.কম স্যার (শ্রদ্ধেয় ছানা উল্যাহ বি.কম)। সে সময়ের তরুণ, উদ্যমী, প্রাণচঞ্চল এ স্বপ্নের ফেরিওয়ালা প্রথম ক্লাসেই (আমার জন্য প্রথম) মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলেন। কিন্তু সে মনোযোগ থেকে যে হিসাববিজ্ঞানের আজীবন ছাত্র হয়ে যাবো, তা কে জানতো!

(এ সময়ের ভেতর আমরা বেঙ্গলি মোস্তফা, ইংলিশ মোস্তফা, হাদি মোস্তফা, কাশেম মোল্লা, ফিরোজ খাঁন, এনায়েত উল্যাহ বি.কম, শিমুল শিকদার, ফারুক স্যারসহ অনেক অতিথি শিক্ষকের সান্নিধ্য পাই)।

২০ এপ্রিল থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হলো। আমরা বিশ জন মাইজদীস্থ পৌরকল্যাণ স্কুলকেন্দ্রে পরীক্ষা দিলাম। ফলের দিন (৯/১০/’৯৫) কেন্দ্রে যাইনি কেউ। চেয়ারম্যান (অ্যাডভোকেট এনামুল হক) ফল আনতে গেলেন। মাস্টার ছিদ্দিক উল্যাহ, খালেকুজ্জামান মিয়া, আজাদ কাকা (নুরুল ইসলাম আজাদ) এবং আমাদের স্যারেরা ফলের অপেক্ষায়। প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে এলেন চেয়ারম্যান। সবাই বেশ উদ্বিগ্ন। মোটরসাইকেল থেকে নেমে শিশুর মতো নাচতে নাচতে বললেন, আমার হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। আনন্দে কাঁদছেন কেউ কেউ। চেয়ারম্যান বললেন, আমরা নাকি শুধু পাস করিনি, ছাড়িয়ে গেছি শতবর্ষী শত বিদ্যপিঠকেও। এই অঞ্চলের শিক্ষার কিংবদন্তি মাস্টার ছিদ্দিক উল্যাহর বুকের মাঝে আমি। পৃষ্টদেশে আবারও উষ্ণ জলের অনুভূতি পেলাম। যেমনটা পেয়েছিলাম ঠিক দু’বছর আগে।

আজ বাবা নেই। নেই অ্যাডভোকেট এনামুল হক, মাস্টার ছিদ্দক উল্যাহ, জাফরুল্লাহ স্যার কিংবা সন্তোষ স্যার। সেলিম, জিকোরাও সীমানার ওপারে। বাবা বেঁচে থাকলে সুবর্ণ জয়ন্তির এমব্রয়ডারি করা গর্বিত ড্রেসে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। বলতাম, আজ আমার স্কুলের পঞ্চাশ বছর। আনন্দে তার দু’চোখ ছলছল করে উঠতো। কিন্তু সময় তো আর বাবাদের জন্য থেমে থা কেনা। সময় বয়ে যায়।

মন্তব্য