বেশি লাভের আশায় তরমুজ চাষ করে এখন লোকসান গুনছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ১৬ হাজার চাষি। তারা বলছেন, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকরা যে লাভের আশায় অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ও মহাজন থেকে ঋণ নিয়ে তরমুজ চাষ করেছেন, সেই আশায় এখন গুড়েবালি। এখন ঋণের কিস্তি শোধ করবেন কিভাবে, সে চিন্তায়-ই অনেকেরই মাথায় হাত। ফসলহানিরে কারণে কৃষকদের ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করলেও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান ছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আবুল হোসেন।
এ বছর ১২ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলেন সুবর্ণচর উপজেলার দক্ষিণ কচ্ছপিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম। বীজ, সার, কীটনাশকসহ তরমুজ চাষে ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তার। বিক্রি করেছেন মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার তরমুজ। এরমধ্যে বিভিন্ন অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান থেকে মৌসুমি ঋণ করেছেন ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এর বাইরে রয়েছে স্থানীয় মহাজন থেকে নেওয়া সুদের টাকা। বেশি লাভের আশায় চাষ করে এখন ঋণ পরিশোদ না করতে পারায় গ্রাম ছাড়ার উপক্রম হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শুধু জাহাঙ্গীর আলমই নন, এ বছর সুবর্ণচরে তরমুজ চাষ করে আর্থিক লোকসানে পড়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পালানোর উপক্রম হয়েছে সব তরমুজ চাষিরই। গত বছর ১৬ হাজারেরও বেশি কৃষক এ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। কৃষকরা বলছেন, ঋণ পরিশোধের সময় না বাড়ালে কিংবা সরকারিভাবে প্রণোদনা না দিলে ক্ষতি পুষিয়ে প্রায় অসম্ভব।
স্থানীয় ঋণদাতা এনজিওগুলো বলছে, পিকেএসএফ ও দাতা সংস্থাগুলো চাইলে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রয়েছে অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত একদশকেরও বেশি সময় সুবর্ণচরে রবি মৌসুমে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি তরমুজ চাষ করে আসছেন কৃষকরা। অল্প সময়ে ভালো লাভ হওয়ায় এবং বাজারজাতে সুবিধা থাকায় মূলত তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন কৃষকরা। কিন্তু গত বছর এ অঞ্চলে তরমুজে স্বল্প পরিসরে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস রোগ দেখা দেয়। একই রোগ এ বছর ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ায় তরমুজের সিকিভাগও ক্ষেত থেকে তুলতে পারেননি তারা। এতে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে ১৬ হাজারেও বেশি কৃষককে।
কৃষকরা জানান, বিভিন্ন এনজিও, অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান ও মহাজন থেকে চওড়া সুদে ঋণ নিয়ে তারা তরমুজ চাষ করেন। কিন্তু ফলন বিপর্যয় হওয়ায় উপজেলার তারা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। ফলে ঋণ পরিশোধ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। আসন্ন আমন মৌসুমে ধান আবাদ করতে না পারার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে তাদের। একদিকে এনজিও ও মহাজনের ঋণ পরিশোধের চাপ, অন্যদিকে সংসারের ব্যয়ভার বহনের চিন্তায় এখন দিশেহারা কৃষকরা।
জানতে চাইলে পূর্ব চরবাটা গ্রামের ছানা উল্যাহ্ বলেন, ‘৭ একর জমিতে তরমুজ করেছি। এতে ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। বিক্রি করেছি মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। লাভ তো দূরের কথা, লোকসান হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা। এর বাইরে নিজে গায়ে-গতরে খেটেছি। এখন ঋণে চাপে ঘর-বাড়িতে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজারে গেলেই কীটনাশক ও সার ব্যবসায়ীদের চাপ, আর প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে আসছেন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঠকর্মীরা। এই পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচতে এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।’
কৃষি বিভাগ উপজেলায় ৯ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের কথা বললেও কী পরিমাণ কৃষক তরমুজ চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তার হিসাব তারা সঠিকভাবে দিতে পারেনি।
তবে স্থানীয় এনজিও ও অর্থলগ্নীকারী অর্ধশত প্রতিষ্ঠান কৃষকদের এ বছর মৌসুমি ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে বেসরকারি একটি হিসাব পাওয়া যায়। বেসরকারি ওই হিসাব মতে—উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কৃষক তরমুজ চাষ করেছেন। প্রতি হেক্টরে কৃষক সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তাদের। ফলন বিপর্যয় হওয়ায় এ অঞ্চলে প্রায় দেড়শত কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা। ভালোভাবে তরমুজ উৎপাদিত হলে এর বিক্রিমূল্য আড়াইশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতো। কিন্তু ফলন বিপর্যয় হওয়ায় প্রায় সব কৃষকই ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এর মধ্যে শুধু স্থানীয় এনজিও সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থাই প্রায় দুই হাজার কৃষককে ৫ কোটি টাকার মৌসুমি ঋণ দিয়েছে। সরকারি দাতা সংস্থা পিকেএসএফ এর অর্থায়নে এসব ঋণ দিয়েছে সংস্থাটি।
সুবর্ণচর উপজেলায় এ বছর তরমুজে ব্যাপক ফলন বিপর্যয় হওয়ার কথা স্বাকীর করেন সাগরিকার নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম সুমন। তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্তের সঠিক হিসাব দাঁড় করিয়ে যদি তা দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে, তাহলে হয়তো কৃষকরা পুনরায় স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা পেতে পারেন। সে জন্য তারা পিকেএসএফ কর্তৃপক্ষকে দুর্যোগকালীন স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা দেওয়ার অনুরোধও করতে পারেন।’
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কোনো হিসাব নেই বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক কোনো সহযোগিতা দেওয়ার সুযোগ নেই।’ তবে সরেজমিন পরিদর্শন করে বিষয়টি খতিয়ে দেখে সামনের মৌসুমে কৃষক চাইলে বীজ সহায়তা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলেও তিনি জানান।
/এসবি/