চিলেকোঠায় বসবাস—নামটি শুনতে মধুর হলেও চিলেকোঠা সবসময় মধুর হয় না। গ্রীষ্মে সূর্য রুদ্ধমূর্তি ধারণ করে, ষোড়শীর সৌন্দর্য, ভরা যৌবনে কাপড়চোপড় দিয়ে যেমন ঢেকে রাখা যায় না, তেমনি ওই সময় ফলস সিলিংও আর কাজ করে না। চিলেকোঠায় থাকলে রুচি নষ্ট হয়, লজ্জা কমে যায়। প্রতিদিন সাততলা ভেঙে ওঠানামা করতে হয়।
বাসায় আসার জন্য কোন বন্ধু কল করলে কথা বলার ফাঁকে আমার অবচেতন মন চিন্তা করে তাকে দিয়ে কী আনাতে হবে। কখনো বন্ধুকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলি, কখনো লবণ। পড়ন্ত বিকালে চিলেকোঠা মিষ্টিরোদে মুক্তার দানার মতো ঝলমলে হয়ে ওঠে, সৈকতের তরুণীর হাসির মতো মিষ্টি বাতাস বইতে শুরু করে। শূন্যের ওপর একটি বিন্দুকে কেন্দ্র করে মেঘের নিচে গাঙচিল উড়ে বেড়ায়। আকাশজুড়ে কত মেঘ, কত রঙ! সংঘাত নেই, নেই শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার। সব রঙ মিলে গড়ে তোলে রংধনু। নিসর্গের আবহে সে আলুলায়িত হয়ে ওঠে, দূর লণ্ঠনের আলোয় আলোছায়া বিস্তার করে নিস্তব্ধ সন্ধ্যা। শুধু কি আকাশেই বহু রঙ খেলা করে, না কি আমাদের মনেও রঙেরা ভেসে বেড়ায় সঙ্গীতের সুরের মতো?
আমাদের মনে কখনো আবেগ, কখনো যুক্তি প্রবল হয়ে ওঠে। কখনো বিরহে নীল, কখনো ভালবাসায় সিক্ত হয় অতৃপ্ত মন। কখনো কারও ভালোবাসায় পঞ্চমুখ, আবার কখনো কারও প্রতি বিদ্বেষে তাকে করে তোলে অন্ধ। আকাশের রঙের মতো তারাও গড়তে পারতো ভালোবাসার রঙধনু, যুগলের ঐক্য ও যুবতীর স্তনের মতো প্রীতিময় বন্ধন, সহাবস্থান।
বন্ধুর ডাকে সচকিত হয়ে উঠি। কুশল বিনিময় করতে করতে অদ্ভুত এক আন্তরিকতায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে আবার দশের দেশের আলোচনা হয়। আলোচনা হয় ফণীর মতিগতি নিয়েও। ফণীরা উপকূলে আকৃষ্ট হয়, আমার বাড়িও উপকূলে। বন্ধু জিজ্ঞেস করে তোমার বাড়ি কই, তা তো ভুলে গেছি। উত্তর দেই সুবর্ণচর। সে একগাল হেসে, আবার গম্ভীর হয়ে ওঠে। আমি আলস্য কাটিয়ে প্রশ্ন করি, হাসলে কেন? সুবর্ণচর তো ধর্ষণের স্বর্গরাজ্য, সে উত্তর দেয়। আমি বলি, তোমার অভিযোগের যেমন সত্যতা আছে, তেমনি এতে আছে অন্ধত্বও। তুমি সুবর্ণচরের যে সৌন্দর্য দেখতে পাওনি, তাহল ধর্ষণ সবখানেই ঘটছে, কিন্তু সুবর্ণচরের মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে, তা ভাইরাল করেছে। ফলে তা ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের ভাষা পেয়েছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। দেখো, আমরা দু’জন বন্ধু একটি হৃদ্যতায় আবদ্ধ, কিন্তু আমাদের মনের রঙ অনেক। তুমি শুধু সুবর্ণচরের ধর্ষণের বীভৎসরূপটি দেখেছ, আর আমি দেখেছি সৌন্দর্যটি। একটি বই, একটি বাক্য একেক পাঠককে একেক অর্থ দেয়। কারণ মনের রঙ অনেক। আকাশের রঙও অনেক, কিন্তু তাতে ফুটে ওঠে রঙধনু। আর মনের বিচিত্র রঙে ফুটে ওঠে বিভেদ, বিদ্বেষ ও শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার। বন্ধুটি আন্তরিকতায় হেসে বলল, হু।
তারার আলোয় জীবনের গল্পে আমরা আবার হারিয়ে যাই। চিলেকোঠায় একটি রুম, কদিন ধরে আমি একা থাকছি। গ্রীষ্মকাল, দেয়াল থেকে ভ্যাপসা গরম বেরুচ্ছে। অন্ধকার রুমে ফ্যানের পাখাটা নিরন্তর ঘুরছে, ঘন অন্ধকারে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমার প্রেমিকার ছায়ামূর্তি। দীঘল লম্বা চুল তরঙ্গে দুলছে শৈশবের মতো, যেন বাতাসে ভেসে চলে যাবে। কিন্তু পরক্ষণে আবার নেতিয়ে পড়ছে সুউচ্চ বুকটির ওপর। নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করল, কেন আমায় ছেড়ে গেলে? আমি আনমনে বলে উঠলাম, মনের রঙ অনেক। সেদিন তোমায় ভালো লেগেছিল, পরে ঘোর কেটে গেছে। তাই ভালো লাগেনি, তবে আজ আবার মায়া লাগছে। ছায়ামূর্তিটি ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমি আর্তনাদ করে বলি, চলে যাচ্ছ কেন? আরেকটু থাকো। অস্ফূট একটা ধ্বনি হাওয়ায় মিলে গেল, প্রতিধ্বনি হল ‘মনের রঙ অনেক’। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে, টিনের চালে একটা চাঁপা আর্তনাদ ক্রন্দন করে যাচ্ছে, তা বিধবার স্বামীর মৃত্যুতে ক্রন্দনের মতো নয়, প্রেমিকা ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকের ক্রন্দনও এ নয়। তাহলে থেমে যেতো। বিধবার ক্রন্দন হলে তিন তহুর পর নতুন স্বামীর উঞ্চ আলিঙ্গনে আদ্রতা ফিরতো কান্নার বুকজুড়ে। প্রেমিকের হলে রাতজাগা চ্যাটের ভিড়ে হারিয়ে যেতো ক্রন্দনের ভয়াল সুর। কিন্তু তার ক্রন্দনের সুর আরও করুণ হচ্ছে, দীর্ঘতার আবেশ জড়িয়ে যাচ্ছে, তরঙ্গের প্রতিধ্বনি মৃদু হয়ে উঠছে। এ হচ্ছে মানবতার ক্রন্দন। আমার প্রেমিকার ছায়ামূর্তিটি আবার ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ক্ষীণ একটি স্বর গুঞ্জরিত হচ্ছে—মনের রঙ অনেক, ভালবাসার স্পন্দন একটি, তাহলো পারস্পরিক বোঝাপড়া।