খবরের শিরোনাম দেখে আমি শিউরে উঠেছিলাম— একজন মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে! আমি ভাবলাম, না জানি কোন দেশে এরকম একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে, আমাদের দেশে তো কখনো এরকম নিষ্ঠুরতা হয় না। খবরের ভেতরে চোখ বুলিয়ে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম!
ভয়ঙ্কর ঘটনাটি আমার দেশের ঘটনা, লালমনিরহাটে অক্টোবরের ২৯ তারিখ ঘটেছে। যতই খবর আসতে থাকলো ততই খবরটি আরো অবিশ্বাস্য এবং আরো ভয়ঙ্কর মনে হতে থাকলো। শহীদুননবী জুয়েল নামের যে মানুষটিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে তিনি ধর্মপ্রাণ মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। কোরআন শরীফের অবমাননা করেছেন অপবাদ দিয়ে তাকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে। খবরের যে অংশটি সবচেয়ে হৃদয় বিদারক সেটি হচ্ছে- যখন তাকে অসংখ্য মানুষ মিলে আক্রমণ করেছে তখন তাকে উদ্ধার করে কোনো একটি অফিসে নিয়ে আসা হয়েছিল, কিন্তু তার পরেও উন্মত্ত জনতার হাত থেকে তাকে রক্ষা করা যায়নি, তারা সেখান থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করেছে। তাহলে কী মেনে নিতে হবে আমাদের দেশে আসলে কোনো মানুষের নিরাপত্তা নেই? একজন নিরাপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে একটা অপবাদ দিয়ে কিছু মানুষকে উন্মত্ত করে ফেলে যখন খুশি তাকে মেরে ফেলা যাবে? পুলিশ, র্যাব গিয়েও তাকে বাঁচাতে পারবে না? ছেলেধরা অপবাদ দিয়ে আমরা কী এর আগে একজন নিরপরাধ মহিলাকেও হত্যা করার ঘটনা দেখিনি?
লালমনিরহাটের ঘটনার তিন দিন পরে আমরা আবার একই ধরনের আরেকটি ঘটনার খবর পেয়েছি। এটি কুমিল্লার মুরাদনগরের ঘটনা। আমাদের খুবই সৌভাগ্য সেখানে কেউ মারা যায়নি, যাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল, তারা আগেই বাড়ি থেকে সরে গিয়েছিলেন। তাদের বাড়িগুলো পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে খবর ছড়ানো হয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের সঙ্গে কেউ একাত্মতা প্রকাশ করেছে, তারপর রীতিমতো মাইকে ঘোষণা দিয়ে পরের দিন ঢালাওভাবে সবার উপর আক্রমণ। উন্মত্ত মানুষ যখন বাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে তখন ফায়ার-ব্রিগেডকে সেই আগুন নেভানোর জন্য যেতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ এবং প্রশাসনের নাকের ডগায় সেই ঘটনা ঘটেছে— আবার সেই একই ব্যাপার, তাদের বাড়ি-ঘর রক্ষা করা যায়নি। লালমনিরহাটে যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। মুরাদনগরে যাদের বাড়ি পোড়ানো হয়েছে তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আমাদের দেশটি এরকম ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হয়ে গেল কেমন করে?
এই ঘটনাগুলোর কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। আমরা রামুতে এটা ঘটতে দেখেছি, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও ঘটতে দেখেছি, দেশের অন্যান্য জায়গাতেও প্রায় নিয়মিতভাবে এরকম ঘটনা ঘটছে। সব জায়গাতেই মোটামুটি একই ধরনের ঘটনা, প্রথমে ফেসবুকের নামে কোনো একটা রটনা হয়, তারপর মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, তারপর শতশত উন্মত্ত মানুষ ধর্ম রক্ষার নামে উন্মত্ত হয়ে ছুটে আসে। পুলিশ কিছু করতে পারে না কিংবা করতে চায় না এবং ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনা ঘটে যায়। বিষয়টা শুধু ধর্মীয় উন্মত্ততা থেকেও বেশি কিছু হতে পারে, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে, কারণ অনেক সময় দেখা যায় যারা আক্রমণ করছেন তারা স্থানীয় মানুষ নয়, তাদেরকে অন্য এলাকা থেকে আনা হয়েছে!
এইসব ঘটনাগুলো করা হয় ধর্মের নামে। অথচ ইসলাম ধর্মের কোথাও এ ধরনের কথা বলা নেই। যারা এগুলো করে তারা আর যাই বিশ্বাস করুক ইসলাম ধর্মকে বিশ্বাস করে না। আমি পবিত্র কোরআন শরীফ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি, যে কথাগুলো আমার চোখে আলাদাভাবে পড়েছে সেটি হচ্ছে কতবার সেখানে সীমালঙ্গন না করার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ তাদের কাজকর্মে যদি সীমালঙ্ঘন না করতো তাহলে এই পৃথিবীটাই কী একটা অন্যরকম পৃথিবী হয়ে যেতো না? কোরআন শরীফের যে আয়াতটি আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং যেটি আমি অসংখ্যবার অন্যদের শুনিয়েছি সেটি হচ্ছে এরকম, তুমি যদি একটি মানুষকে হত্যা করো তাহলে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করো (৫:৩২)— এরকম একটি অসাধারণ কথা শোনার পরও কেমন করে একজন মানুষ ধর্মের নামে আরেকজন মানুষকে হত্যা করতে পারে? হযরত মুহাম্মদ (স:) বিদায় হজ্বের সময় একটি অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণের এক জায়গায় তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে অতীতে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। কোরআন শরীফকে অবমাননা করা হয়েছে এরকম একটি অপবাদ দিয়ে যদি একজন ধর্মপ্রাণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না হয়ে থাকে তাহলে আর কী বাড়াবাড়ি হতে পারে?
খবরের কাগজে দেখেছি লালমনিরহাটের সেই ঘটনার পর বেশ কিছু মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শহীদুজ্জামান জুয়েলের আপনজনের এই মুহূর্তে সান্ত্বনা পাবার কিছু নেই, যারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে এই দেশ, দেশের সরকার এবং আমাদের মতো দেশের মানুষেরা কি অপরাধবোধের বোঝা একটুখানিও কমাতে পারবো? শহীদুজ্জামান জুয়েলের একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল, তাঁর কাছে শুনেছি জুয়েলের একজন সদ্য এইচএসসি পাস করা মেয়ে আছে। এই মেয়েটির এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর কি কিছু আছে? জুয়েল রংপুর পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করতেন, শুনেছি তাঁর লাইব্রেরিতে কোনো একটি অনৈতিক ঘটনা কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করার কারণে উল্টো তাঁর নিজের চাকরিটাই চলে গেছে। সে কারণে তিনি মানসিকভাবে একটু বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। পুরো বিষয়টি কি আরও একটু ভালো করে তদন্ত করে দেখা উচিত নয়? তাঁর জীবনটা তছনছ করে দেওয়ার জন্য আরো কোথাও কি তাঁর উপর অবিচার করা হয়েছিল? এই পরিবারের উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই, সরকার এবং প্রশাসনের অবশ্যই এই পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে যাবার পর অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের সাহায্য করা দেশের সরকারের দায়িত্বের ভেতর পড়ে। তবে সেই ঘটনাটি ঘটতেই না দেওয়া আসলে সরকারের সত্যিকারের দায়িত্ব।
তাই আমরা আশা করব, সরকার তার মূল দায়িত্বটি আগে পালন করবে— এই দেশে এরকম ঘটনা ঘটতেই দেবে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আরো অনেক বেশি সতর্ক থাকবে, তাদের ইন্টেলিজেন্স আরো অনেক বেশি কার্যকর হবে। মুরাদনগরের ঘটনার পর সেখানকার পুলিশের কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ এসেছে, তাদের কেউ কেউ নাকি বলেছেন, ইউনিফর্ম পরা না থাকলে তারাও এই ধর্ম রক্ষার আন্দোলনে যোগ দিতেন! এরকম পুলিশ কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করতে হবে যারা আমাদের দেশের মূল আদর্শকেই বিশ্বাস করে না।
সামনের বছরটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর। যে স্বপ্নটিকে সামনে রেখে ৫০ বছর আগে আমাদের দেশ মুক্ত করা হয়েছিল সেটিই কী আমাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন নয়? এই স্বপ্ন পূরণের জন্য আর কতো কাল আমরা অপেক্ষা করবো?
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক