কৃষকের জীবনের সে সোনালি গৌরবের দিন ছিল, বর্তমানে তা অনুপস্থিত। দেশের অন্নসংস্থানের মহান ব্রতে নিয়োজিত কৃষকেরা মর্যাদা পাওয়া দূরের থাক, দুবেলা দুমুঠো ভাতও পান না! তারা নানা রোগশোকে জর্জরিত, দুঃখে-কষ্টে ও পরিশ্রমে কঙ্কালসার। মান্ধাতা আমলে কৃষি পদ্ধতি কঠিন ছিল কিন্তু মর্যাদা ছিল কৃষকদের। বর্তমানে কৃষি জমি যেমন খণ্ড খণ্ড তেমনি কৃষকও বিচ্ছিন্ন-ঐক্যহীন। আদিকালের লাঙল-জোয়াল-গরু-কাস্তের কৃষক ছিলেন সমাজের উঁচু মাপের গণ্যমান্য সমাজপতি। বর্তমানের কৃষক মর্যাদাহীন গরিব ও নিম্নশ্রেণীর!
কৃষকের সোনালি অতীত ধবংস করে দিয়েছে অসাধু আড়তদার, মজুতদার-সিন্ডিকেট। ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে গত বছর কৃষক তার রক্তে উৎপাদিত সোনালি ধান মাঠে কবর দিয়েছিলেন! আমি শিক্ষকের ছেলে হলেও কৃষির সঙ্গে চৌদ্দ পুরুষ ধরে যুক্ত। কৃষির সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা পুরনো, যদিও মাঠে-ময়দানে কম থাকি। কৃষকের শ্রম, মেহনত, রক্ত, ঘাম, টেনশন নিদারুণ সুগন্ধিযুক্ত, তা এবার প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধির সুযোগ হয়েছে। ধানকাটা, মাড়াই, শুকানো কী কঠিন তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। কৃষকের হাত যেমন শক্ত, তেমনি প্রতিটি কাজও কঠিন। সেই শক্ত হাতে কঠিন কাজ করেন কৃষক, তা অনুপম, সুন্দর, পুষ্পময়, নান্দনিক ও সোনালি।
দেশের মেরুদণ্ড সোজা রাখা কৃষক এতকাল ছিলেন অনাদৃত, উপেক্ষিত, শোষিত ও নিগৃহীত। এবার হাসি ফুটুক সোনার বাংলার সোনালি ধানের কারিগরদের।
প্রান্তিক কৃষকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নগদ অর্থ ও জমি! কৃষি মৌসুমে নগদ অর্থ না থাকায় চড়া সুদে মহাজনদের থেকে টাকা নিয়ে কৃষি কাজ শুরু করেন তারা। জমি চাষ, রোপণ, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, ধান কাটা, মাড়াইয়ের কাজে যে টাকা খরচ হয়, তার অধিকাংশই সুদের ওপর নেওয়া! এতো কষ্টের সোনালি ধান ঘরে তোলার আগেই শ্রমিকের মূল্য পরিশোধ করতে, মহাজনেদর সুদের টাকা দিতে, ঘর না থাকায়, প্রতিকূল পরিবেশের কারণে সস্তায় ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষক। সরকার ন্যায্যমূল্যে ধান কেনে। এবার ধান কিনবে করবে কোরবানের পর। এতদিন কৃষক ধান রাখবেন কোথায়? যেখানে পরিবার নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া যায় না, সেখানে ধানের গুদাম তৈরি বিলাসিতা মাত্র!
আরেকটা কথা, কৃষকের তালিকা করে সরকার। কিন্তু সেই তালিকায় কৃষকের চেয়ে অকৃষকের সংখ্যা থাকে বেশি। লটারি হয়! লটারিতে যাদের নাম আসে, তাদের থেকে ধান নেবে সরকার। লটারিতে গন্ধযুক্ত কৃষকের নাম কম ওঠে! ওঠে ইস্তিরি করা জামা গায়ে দেওয়া লোকের। কৃষক খাদ্যগুদাম চেনে না, কৃষি অফিসার চেনে না, চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে যেতে মাধ্যাম লাগে। সরকারের ভুর্তুকি কী, তাও জানে না। কৃষকের অজ্ঞতার সুযোগ নেন ওপরতলার লোকজন মিয়া, ভুঁইয়া, চৌধুরী, খান। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সহজ করে লটারি-ফটারি বাদ দিয়ে সরকারের উচিত প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা। এই বছর ফসলের অবস্থা সন্তোষজনক, আবহাওয়া কৃষকের অনূকূলে। দেশের মেরুদণ্ড সোজা রাখা কৃষক এতকাল ছিলেন অনাদৃত, উপেক্ষিত, শোষিত ও নিগৃহীত। এবার হাসি ফুটুক সোনার বাংলার সোনালি ধানের কারিগরদের।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী