করোনা একটি ভয়াবহ সংক্রামক ভাইরাস। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে প্রথমে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও অঞ্চলে। এতে প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। বিশ্বে এ পর্যন্ত ৩ লাখ ১৩ হাজার ৮০৫ জন মানুষ মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭ লাখ ৫০ হাজার ৪০৩ জন। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর এখানেও বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এখন পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিনেই সফলতা আসেনি। তাই আতঙ্ক বিরাজ করছে আরও বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশেও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
করোনা কী
করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস—যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটির আরেক নাম ‘২০১৯-এনসিওভি’ বা ‘নভেল করোনাভাইরাস’। এটি এক ধরনের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ছয়টি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে নতুন ধরনের ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা এখন থেকে হবে সাতটি।
২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল আর ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয়েছিল। সেটিও ছিল এক ধরনের করোনাভাইরাস।
তাই তো নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে। চোখ, মুখ, নাক ও কানে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। যেহেতু এখনো কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, তাই প্রতিরোধ করতে সচেতন হতে হবে সবাইকে।
নতুন এই রোগটিকে প্রথম দিকে নানা নামে ডাকা হচ্ছিল। যেমন—’চায়না ভাইরাস’, ‘করোনাভাইরাস’, ‘২০১৯ এনকভ’, ‘নতুন ভাইরাস’, ‘রহস্য ভাইরাস’ ইত্যাদি। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় ‘কোভিড-১৯’ যা ‘করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
করোনার ইতিহাস
করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথম দিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রংকাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এ রকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’নামে নামকরণ করা হয়। তবে অনেকের সন্দেহ হয় যে, এই ভাইরাসটি চীন সরকার তার দেশের গরিব জনগণকে শেষ করে দেওয়ার জন্য নিজেরাই তৈরি করে নিজেরাই ছড়িয়ে ছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরও বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে এসএআরএস-সিওভি-২’ পাওয়া যায় (যা বর্তমানে সাধারণত নভেল করোনাভাইরাস নামেই পরিচিত। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।
কিভাবে ছড়ায়
মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১ ডিসেম্বর এ শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। তবে ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তা এখনও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। তবে তারা বলছেন, সম্ভবত কোন প্রাণী এর উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই প্রথমে ভাইরাসটি কোন মানুষের দেহে ঢুকেছে, এবং তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। এর সাথে উহান শহরে সামুদ্রিক খাবারের একটি বাজারে গিয়েছিল এমন লোকদের সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ওই বাজারটিতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো। কিছু সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন- বেলুগা জাতীয় তিমি করোনাভাইরাস বহন করতে পারে। তবে উহানের ওই বাজারে জ্যান্ত মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, এবং সাপ বিক্রি হতো। হয়তো এগুলোর কোন একটি থেকে এই নতুন ভাইরাস এসে থাকতে পারে।
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতিমধ্যেই ‘মিউটেট করছে’ অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে- যার ফলে এটি আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়াতে পারে এবং বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন যে, এ ভাইরাস একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে ছড়াতে পারে। এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেক জনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। এ ছাড়া করমর্দন, কোলাকুলি বা কোনো রকম স্পর্শ থেকে ছড়াতে পারে। তাই তো নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে। চোখ, মুখ, নাক ও কানে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। যেহেতু এখনো কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, তাই প্রতিরোধ করতে সচেতন হতে হবে সবাইকে।
বাংলাদেশে করোনার সার্বিক পরিস্থিতি
বাংলাদেশে করোনার সার্বিক পরিস্থিতি হতাশাজনক। এভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই ভয়াবহতার মুখোমুখি হবে বলে মনে হয়। যদিও মার্চ মাসে বাংলাদেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও চীন বাংলাদেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সামগ্রী ঢাকায় এসে পৌঁছেছে এবং কয়েক দিনের মধ্যে চীন থেকে আরও চিকিৎসা সামগ্রী বাংলাদেশে পৌঁছাবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল বলা যায়।
যা আসলেই মানবতার চরমতম উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে থাকবে। আশা করি, সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই একদিন আমরা করোনা মহামারী থেকে মুক্তি পাবো।
সম্প্রতি মে মাসের ১৭ তারিখের পর থেকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চিন্তিত দেশের সুশীল সমাজ। ওদিকে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের দিকেই যাচ্ছে বলে তারা মনে করেন৷ তাদের মতে, করোনা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্লেষকরা বলেন, একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে করোনা আক্রান্তরা কার সংস্পর্শে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন তা আর এখন নির্ণয় করা যাচ্ছে না, যা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের লক্ষণ৷ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) অল্প কিছু মানুষকে পরীক্ষার আওতায় নিচ্ছেন৷ বড় অংশটিই এর বাইরে থেকে যাচ্ছে৷ তাদের সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনা গেলে বাস্তব পরিস্থতি বোঝা যেতো৷ নো টেস্ট, নো করোনা—এই নীতি কোনেভাবেই ঠিক না৷ সংবাদমাধ্যমসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশে করোনা কমিউিনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে পৌছে গেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
গত ১৭ মে পর্যন্ত আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২২ হাজার ২৬৮ জন। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩২৮ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪ হাজার ৩৭৩ জন। তবে গত এক সপ্তাহে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।
সামাজিক সংগঠনের ভূমিকা
করোনাভাইরাস রোধে সরকার, প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। কারোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন অঞ্চল লকডাউন করে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন। ফলে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েন। কেউ কেউ বাসায় বসে অফিসের কাজ করে থাকেন। শিক্ষা কার্যক্রম চলতে থাকে টেলিভিশন ও অনলাইনের মাধ্যমে। এমন পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো অসহায় হয়ে পড়েন। তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে সামাজিক সংগঠনগুলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্রিক কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে রাতারাতি। পাশাপাশি বিভিন্ন পাড়া বা মহল্লা ভিত্তিকও সংগঠন গড়ে ওঠে। যারা অসহায়, দরিদ্র, দিনমজুর, নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
সামাজিক সংগঠনগুলো নগদ অর্থ, রান্না করা খাবার, খাদ্যসামগ্রী, রমজানে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালায়। নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে কাজ করে। মূলত সামাজিক সংগঠনগুলো এগিয়ে না এলে এতবড় মহামারী মোকাবেলা করা খুবই কঠিন হয়ে পড়তো। সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে বলে আমার মনে হয়। তারা অনেক অসহায় মধ্যবিত্ত পরিবারকে খুঁজে খুঁজে রাতের অন্ধকারে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে। যা আসলেই মানবতার চরমতম উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে থাকবে। আশা করি, সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই একদিন আমরা করোনা মহামারী থেকে মুক্তি পাবো।