প্রাপ্তি আছে, প্রত্যাশা আছে। আছে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার মতো মানুষের প্রতি মানুষের মানবিকতা। কিন্তু প্রাপ্তি-প্রত্যাশা কিংবা সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি আপাতত দূরে-ই থাক্। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা দেখারই যেন কেউ নেই।
এক সময় যাদের গোয়াল ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর আঙিনাজুড়ে সবজির বাগান ছিল, নদী ভাঙার আগ্রাসনই এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। সকালে আমির তো, বিকেলে ফকির; এমন বাস্তবতা সুখে শান্তিতে বসবাস করা উপকূলবাসীর জীবনে ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।
বলছিলাম দ্বীপ হাতিয়ার কথা। এটি নোয়াখালী জেলার মানচিত্রে বর্তমানে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হিসেবে উল্লিখিত হলেও একসময় নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির কারণে দেশের সর্বত্র পরিচিত একটি স্থান ছিল।
বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ আর প্রমত্তা মেঘনার ভাঙনের খেলায় হাতিয়ার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি বহু আগেই নদীগর্ভে বিলীন করে দিয়ে এখন পরিণত হয়েছে দ্বীপে।
এখন শুধু এই ভূ-খণ্ডের অস্তিত্বকে মানচিত্রের মাঝে টিকিয়ে রাখতে নিরন্তর চেষ্টা এখানকার বসবাস করা মানুষগুলোর। নদীভাঙনরোধে নিজেদের কিছুই করার সামর্থ্য না থাকলেও বহুবার বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন তারা। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি বরং ব্যর্থ হচ্ছে বারংবার।
নদীভাঙার আগ্রাসনে নিঃস্ব হয়ে হাতিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল কেরিং চরে বসবাস করা ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ ওসমান ফকির এই প্রতিবেদককে জানান, ৫ বার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে এখন এ নতুন চরে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে ঠাঁয় নিয়েছিল ৭ বছর আগে। কিন্তু বছরখানেক আগেই এখানেও ভাঙনের শিকার হয়ে আবারও স্থান পরিবর্তন করে একই চরের আমতলি এলাকায় ঘর তুলেছেন রাস্তার পাশে সরকারি জায়গায়।
কিন্তু তাতেও কোনো স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা দেখছেন না বলে জানান ওসমান ফকির। আগামী দু-তিন বছরের মধ্য এই জায়গাটিও নদীভাঙনের কবলে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এমন দুঃখ-দুর্দশা শুধু ওসমান ফকিরের জীবনে-ই নয়। হাতিয়ার উপকূলে নতুন করে জেগে ওঠা বয়ারচর, নলেরচর, নিঝুমদ্বীপ, ধমারচর, কালামচরসহ প্রায় নতুন বিশটি চরে বসবাস করা দেড় লক্ষাধিক মানুষও দুই-পাঁচ বার নদী ভাঙার আগ্রাসনে নিঃস্ব হয়েছে।
ওয়েব স্টার নামের একটি সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৮৯০ সাল থেকে হাতিয়ার মূল ভূ-খণ্ডের উত্তর ভাগের ভাঙন শুরু হয়। তবে ওই সময় ভাঙনের তীব্রতা ছিল খুবই ক্ষীণ। মূলত নোয়াখালীর মূল ভুখণ্ড রক্ষায় ১৯৫৭ সালে ভবানীগঞ্জ চর লরেন্সে ১.৪ মিলিয়ন রুপি ব্যয়ে একটি ক্রস ড্যাম এবং ১৯৬৪ সালে ৯ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে আটকপালিয়া মান্নান নগরে আরেকটি ক্রস ড্যাম নির্মাণ করার পর হাতিয়ার নদীভাঙন বহুগুণে বেড়ে যায়।
এছাড়া সন্দ্বীপ চ্যানেল, হাতিয়া চ্যানেল, কুতুবদিয়া চ্যানেল এবং নাফ নদীর জোয়ারের পানি হাতিয়া ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় বেশি ক্রিয়াশীল হওয়ায় এটি তীব্র ভাঙনে রূপ নেয়।
এর ফলে হাতিয়া উপজেলার উত্তরাঞ্চলের হরনী, চানন্দী, সুখচর ও নলচিরা ইউনিয়ন মেঘনায় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া চরকিং ইউনিয়ন, চরঈশ্বর ইউনিয়ন, তমরদ্দি ইউনিয়ন ও সোনাদিয়া ইউনিয়নের পশ্চিমাংশের বিশাল এলাকা মেঘনার আগ্রাসনে নিমজ্জিত হয়েছে। এখন অব্যাহত রয়েছে।
শুধু তাই নয়, প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে খ্যাত হাতিয়ার পুরাতন শহর, হাতিয়া জামে মসজিদসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ক্ষুধার্ত মেঘনার করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হয়েছে। আর এতে করে হাজার কোটি টাকার সম্পদহানি ছাড়াও দেড় লক্ষাধিক অধিবাসী ভিটেমাটি হারিয়েছে।
তারা এখন বিভিন্ন সাইক্লোন শেল্টার, বেড়িবাঁধ, কিল্লায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নিয়েছেন।
বর্তমানে তমরদ্দি ইউনিয়ন, চরকিং ইউনিয়ন ও সোনদিয়া ইউনিয়নের বিশাল এলাকা নদীভাঙনের শঙ্কায় রয়েছে। নদীভাঙন রোধে এ যাবৎ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সেগুলো প্রায় ৪৬ বছর পরও সফলতার মুখ দেখেনি।
১৯৭০-এর দশকে তৎকালীন সরকার হাতিয়ার ভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। ভূমি পুনরুদ্ধার ও হাতিয়াভাঙন রোধ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৫ সালের ২৯ অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকার ও নেদারল্যান্ডস সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। ১৯৮১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে হাতিয়ার ভাঙন কবলিত এলাকায় স্পার নির্মাণ করা হয়েছিল। অবশ্য সে কর্মসূচি সফল হয়নি।
পরে ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে ‘ভাঙন রোধের সুপারিশমালা’ বাংলাদেশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু আজও ভাঙন রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, হাতিয়ার ৫৫ ভাগ অর্থাৎ ৩৫-৭০ বছর বয়সী মানুষ কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ বার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। হাতিয়ার ৮০ ভাগ লোক কৃষক ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কৃষি জমি ভেঙে যাওয়ার কারণে অনেক কৃষক বেকার হয়ে পড়েছে। আর এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
সূত্র মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বিগত চার দশকে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তার ৩০ শতাংশ কাজও হয়নি। ফলে নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়নি।
আশার মাঝে হতাশার কথা হলো তমরদ্দি ইউনিয়নের পশ্চিম পার্শ্বে নদী ভাঙ্গন রোধে শত কোটি টাকা ব্যয়ে ব্লক নির্মাণ করা হলেও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে সেটিও অসমাপ্ত থেকে যায়।
নোয়াখালী জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘ইতোমধ্যে পাউবো’র একটি প্রতিনিধি দল হাতিয়ার নদীভাঙন পরিদর্শন করেছে। তারা একটি কারিগরি কমিটি গঠনও করেছেন।’কারিগরি কমিটির রিপোর্টের আলোকে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।