বাবা, কেমন আছো? হয়তো ভালো আছো। কিন্তু তোমার জীবদ্দশায় আমাকে ভালো রাখতে তুমি কখনোই ভালো থাকোনি। তবে তুমি যে কখনোই ভালো থাকোনি, সেটা কেউ না বুঝলেও আমি একটু-আধটু টের পেয়েছিলাম। একবার রহমতপুর বাজার থেকে আমাকে সাথে করে বাড়ি ফিরছিলে। সে দিনটা বোধহয় আষাঢ় মাসের ছিল। মাঝ রাস্তায় আসতেই আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। তোমাকে বলেছিলাম, ‘বাবা চলো দৌড়ে যাই।’ যদিও তখন রাস্তার দূরত্বটা এত বুঝতাম না। তখন তোমার সংসারের কষ্টে জর্জরিত কাঁচ ভাঙার মত বুকে আমায় আগলে রেখে রোদে পোড়া পিঠে সেদিন বৃষ্টিগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিলে। সেদিন যদি ছাতা থাকত, তাহলে মুষলধারে বৃষ্টির ফাঁকে দমকা হাওয়ায় নিমিষেই ভেঙে যেত। কিন্তু তোমায় ভেদ করে একবিন্দু বৃষ্টির ফোঁটাও পড়তে দাওনি আমার শরীরে। সে দিনটার কথা মনে করে আজও বৃষ্টিতে ভিজলাম অনেকক্ষণ। অঝরে কেঁদেছিও। বৃষ্টির সাথে চোখের জলও মিশে একাকার হয়েছে।
আচ্ছা বাবা, তোমার এ চলে যাওয়াটা কি ঠিক হলো? হয়তো এরকম কোন প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছে নেই। থাকলেও না বলার ভান করে আছো। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর আমায় কুড়ে কুড়ে খায় প্রতিনিয়ত।
আচ্ছা বাবা, পৃথিবীর সব বাবা কি আকাশে বিজলীর মত ভাসে, আবার হঠাৎ অন্ধকারে চলে যায়? এই যেমন ধরো, সন্তান যখন বাবার অনামিকা ধরে হাঁটা শেখে, বাবার হাত ধরে যখন সাঁতার শেখে, বাবার কোলে বসে যখন নীল আকাশ দেখে? বাবার কাঁধে বসে যখন চাঁদ ধরতে ইচ্ছে জাগে, তখন? তুমি যেমন চলে গেছো তেমন? এরকম চলে যাওয়ার নিয়ম বাবা বড্ড পুরোনো। এ নিয়মই বুঝি ঈশ্বরের বিশেষ পছন্দ। না হলে পৃথিবীর সব বাবা আজ বেঁচে থাকতেন। এমনকি তুমিও থাকতে। আমি আবার তোমার হাত ধরে হাঁটা শিখতাম। তোমার কোলে বসে আবার নীল আকাশ দেখতাম। আচ্ছা বাবা, আমি যখন সন্তানের বাবা হবো, আমিও কি তোমার মত হঠাৎ চুপিসারে সংসার ত্যাগ করব? সে দিনটার কথা ভাবলে তোমার প্রতি প্রচণ্ড রাগ হয় বাবা। সত্যিই বাবা, তোমরা এসব পারও বটে।
গত বছর আমার মেট্রিক পাসের কথাটা খুব মনে আছে। আমার ভালো রেজাল্টের জন্য তুমি যা করেছো। হয়তো তোমার সাফল্যের জন্য হলে এর বিন্দু পরিমাণও করতে না। এই যেমন ধরো, আমার মেধাশক্তি বাড়াতে প্রতিদিন নিয়ম করে দুধ, কলা, ডিম খাওয়াতে। পরিবারে আমার জন্য এসব সত্যিই দুর্গার অতিরিক্ত পূজা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যেদিন রেজাল্ট বের হলো, সেদিন তুমি পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ি বাড়ি ঢোল পেটাচ্ছিলে। যেন আমি রাশিয়া, চীন, আমেরিকা জয় করেছি। কী হলো এসব করে বাবা। আজ আমি বাউণ্ডুলে, ভবঘুরে, বেকার। তুমি থাকলে হয়তো এগুলোকেই বীরদর্পে চালিয়ে দিতে। বাবা এগুলো তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কারো দ্বারা সম্ভব নয়।
বাবা, তুমি তো চিনতেই, আমাদের পাশের বাড়ির মনতাজ আলীকে। ওনার তো ছয় মেয়ে। বড় দুটো মেয়ে প্রতিবন্ধী। এর ছোট মেয়েটা বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু যৌতুকের বলি হয়ে ক’দিন হলো ঘরে ফিরেছে। পরের মেয়েটা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কিসের আর পড়া। স্কুলে একদিন গেলে তিন দিন যায় না। আর যাবেই বা কী করে? অন্য বাচ্চাদের মত পোশাক নেই, টিফিন নেই, জুতো নেই, আরও কত কারণ। মূল কারণটা তো আছেই। মনতাজ আলীর শরীরের যা অবস্থা, একদিন কাজে গেলে পাঁচ দিন বিছানায় কাটে। বাকি দু’টো মেয়ে কোলে-পিঠে ঠাঁই নিয়েছে মনতাজ আলীর বউয়ের। জানো বাবা, ওরা দু’মুটো ভাতের জন্য এত কষ্ট করে। যা দেখলে সত্যিই মায়া লাগে। বাবা, তুমি তো মাঝে মাঝে বলতে, মনতাজ আলী যৌবনে নাকি নায়কের মত ছিল। সুঠাম দেহ, বাবড়ি চুল, টানা চোখ। আর এখন যদি দেখতে, বিশ্বাসই করতে পারতে না বাবা। ছয় ছয়টা মেয়ের ভরণ-পোষণে কী কষ্ট- যাতনায় দিন কাটে মনতাজ আলীর। সেটা তার ঈশ্বর ছাড়া কেউ বলতে পারবে না বাবা। একদিন কী হলো জানো বাবা? মনতাজ আলীকে তার বউ বলছে, ‘ওগো আমাদের এ দৈন্যদশা কখন শেষ হবে? তোমার কঠোর পরিশ্রমে তুমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছ।’ তখন মনতাজ আলী বলে, ‘গাধার মত সারাদিন পরিশ্রম করলেও সন্ধ্যায় যখন ওদের মুখে বাবা ডাক শুনি; তখন সব কষ্ট ভুলে যাই।’ সেদিন থেকে তোমার উপর আমার রাগ কিছুটা লাঘব হয়েছে বাবা। যদিও রাগটা নদীর পাড়ে বাড়ির মত। অতটা মজবুত নয়। তবে মাঝে মাঝে তোমাকে খুব মনে পড়লে জোয়ারের মত উথলে ওঠা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে বাবা তুমি কিছু মনে করো না।
বাবা, পলাশকেও তো তুমি চেন। আরে পলাশ আমার বাল্যবন্ধু। এখন হয়তো চিনবে না। সে তো মস্ত বড় অফিসার। গা-গতরও হয়েছে বেশ মাশাল্লাহ। অনেক দিন পর পলাশ শহর থেকে বাড়িতে এসেছে। আমাকে যাওয়ার জন্য কয়েক দফা খরবও পাঠিয়েছে। তাই যাওয়া দরকার। একদিন আমতা আমতা করে গেলাম পলাশের বাড়ি। গিয়ে দেখি পলাশ আর তার বাবা কথা বলছে। কোন একটা কারণে হয়তো পলাশের বাবা বলছে, ‘এই যেমন তুই মাস শেষে এসে বাবা বাবা করে বাড়িটা মাতিয়ে দিস। এই বাবা ডাক শুনেই তোর অনুপস্থিতের দিনগুলো কেটে যায় আমার।’ এ কথা শোনার পর পলাশের থেকে কোনরকম বিদায় নিয়ে ফেরারি আসামীর মত ছুটে এলাম বাড়ি। এক কোণে তোমার লাগানো বট গাছটার নিচে বসে তোমায় ভাবছি বাবা। তখন দক্ষিণা বাতাস আমায় দোলাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তুমি আমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছ। এ পরশে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম বলতেও পারিনি। এরকমটা আমার প্রায়ই হয় বাবা। এ-ও বাবা তুমি জান না। কেউ বাবা বাবা বলে ডাকলে আমার খুব হিংসে হয়। কেন হয় তা অদৌ জানি না বাবা।
আচ্ছা বাবা, মানুষ বাবা হলে এরকমই হয়? তার স্বাদ-আহ্লাদ ধুলোয় মেশায় তার সন্তানের জন্য? এ বিসর্জনেই কি তোমরা প্রকৃত বাবা হও? এত কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা সয়ে যখন বাবা ডাক শোনো, তখন আকাশ-কুসুম সুখ পাও তাই না বাবা? সত্যি জানতে ইচ্ছে করে খুব। জানা হলোই বা কী করে। তুমি নেই, নীল আকাশটাও নেই। আকাশটাও আর আগের মত খুব বড় লাগে না। অনেক দিন ধরে মনে হয় চাঁদও ওঠে না। ঘোর অন্ধকারে যেন গ্রাস করে রেখেছে আমার এ পুরোনো বিশাল আকাশটা। তবে বাবা, তুমি প্রতি জোৎস্নায় চাঁদ হয়ে আমার আকাশে ওঠো।
ইতি, তোমার আহ্লাদি ছেলে।