(তৃতীয় পর্ব)
জ্যোতিষশাস্ত্রে আমার জ্ঞান সীমিত। হস্তরেখা গণনায় আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি মানুষের সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যারা ভাগ্য গণনা করেন, তারা কেবল এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো বলেন। ফলে আমরা বিস্মিত হই, যখন বেশিরভাগ কথাই আমাদের জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। এটা গণক যখন বুঝতে পারে, তখন সে কিছু ভবিষ্যৎ বিপদের কথা বলে। বিপদগুলো কাটানোর ব্যবস্থাও তার নিকট থাকে। আর আমাদের যাদের কমনসেন্স কম, তারা সহজে এদের ফাঁদে পা দেই। এই দলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষও পার্সেন্টিজে কম নন। কিছু কিছু ঘটনায় আমি নিজেও বিব্রত। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলছি।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। আনুমানিক সকাল নয়টা। আমি ভাগিনা জিল্লুসহ কাছারি ঘরে পড়তাম। ভাতিজা নিজাম, ভাগিনা আজাদ আর তালতো নাজমুল হুদাসহ (নুরুল হুদা) আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় একজন গণক এলেন। আমাদের মাথায় এলো দুষ্ট বুদ্ধি! গণককে নাজেহাল করবো। প্রথমে ভাতিজা নিজামের হাত বাড়িয়ে দিলো। গণক শুরু করলো, আপনার তিনটি বড় বিপদ। দুইটা কেটে গেছে। এরপর জিজ্ঞেস করলো আপনি গাছে উঠতে পারেন? আমি আগ বাড়িয়ে বললাম, পারে মানে!নারিকেল গাছে হেঁটে হেঁটে উঠে যায়। গণক বললো এমাসে আগুন অথবা গাছে আপনার বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। আপনি চাইলে আমি খাড়াটা কেটে দিতে পারি। আমি বললাম কাটা লাগবে না। এরপর নাজমুল হুদার হাত দেখলো। কমন কিছু স্বভাবের কথা বলার পর জিজ্ঞেস করল কী করেন? জবাবে সে বললো পড়ালেখা করি, এবার এসএসসি দেব। গণক বললো, আপনার রেজাল্ট মধ্যম হবে।
আজাদের হাত দেখে কমন কিছু স্বভাবের কথা বলার পর যা বললো, তাতে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। সে বললো, আপনার বিদ্যারেখা ভালো, তবে আপনি রেজাল্ট খারাপ করবেন। আমি বললাম সে চরক্লার্ক উচ্চ বিদ্যালয়ের ফার্স্ট বয়। আপানার গণনা ঠিক না। এবার আমার পালা। ভালো করে আমার হাত দেখলেন। আমার হাতটা ছাড়ছেন না আমার দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, আপনার জীবনরেখা ভাঙা তিন-চারবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। সামনে একটা বড় খাড়া আছে। শনির দশা, বাঁচতে পারলে নব্বই বছর হায়াত পাবেন। একটা পান্না পাথর ধারণ করলে দশা কেটে যাবে। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে বললাম, পাথরের দাম কত? তিনি বললেন, সাতশত টাকা। আমি ছাত্র মানুষ এত টাকা নেই। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, পড়াশোনার কথা বলুন। প্রতি উত্তরে বললেন, আপনি বেশ ভালো রেজাল্ট করবেন। গণকের বেশিরভাগ কথা সত্য মনে হওয়ায় আমরা তাকে নাজেহাল করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাই। এরপর তাকে গণনার জন্য বিশ টাকা দিয়ে বিদায় দিলাম। তবে আমাদের কাজটা আমার জেঠাতো ভাই মরহুম আলা উদ্দীন ঠিকই সম্পন্ন করেছেন।
পুকুরের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমি আকাশে ওড়ার চেষ্টা করছি কিন্তু ঘুমের জন্য পারছি না। যখন ঘুম ভাঙলো আমি মেজো ভাইয়ার মাথার ওপর। আমার পেট বরাবর ভাইয়ার মাথা ঠেকিয়ে আমাকে উপুড় করে রেখে ভাইয়া ঘুরছেন।
আলা উদ্দীন ভাইয়ের বড় ভাই মরহুম জাকার আহম্মদ ও মরহুম সিরাজ উদ্দীন বহুদিন যাবত লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। সঙ্গে আরও সমস্যা ছিল। অনেকদিন ঢাকা মনোয়ারা ক্লিনিকে চিকিৎসা নেওয়ার পর ডাক্তার আশা ছেড়ে দিলেন। হতাশ হয়ে বাড়িতে এনে হোমিও চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। মৃত্যুপথযাত্রী দুই ভাইকে বাঁচানোর জন্য ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি সবকিছু করতে লাগলেন। সেদিন আমাদের হাত দেখার পর গণক গেলেন অন্দর মহলে। কিছুক্ষণ পর বাড়ির ভেতরে থেকে চিৎকার আর চেঁচামেচির আওয়াজ আসছিল। আমরা ভেতরে গিয়ে দেখি গণক সাহেব আলা উদ্দিন ভাইয়ার হাতে ধরাশায়ী। জাকার ভাইয়ার হাত দেখে তিনি বলছিলেন, তাবিজের প্রভাবে এসব হচ্ছে। আর আপত্তিকর বিষয় ছিল ঘরের মানুষের ওপর তাবিজের দোষ চাপিয়ে দেওয়া। আলা উদ্দিন ভাইয়া রাগের মাথায় গণককে শারীরিকভাবে আক্রমন করলেন। বড়রা আলা উদ্দিন ভাইয়াকে থামানোর পর গণক অভিযোগের সুরে বললো, আমি যা বলছি তা সত্যি। আমাকে অন্যায়ভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। জাকার ভাইয়া ছিলেন রসিক মানুষ। মানুষকে হাসাতে পারতেন। গণকের কথা শেষ না হতেই বললেন। তুমি তো মানুষের অতীত-ভবিষ্যৎ সব জানো। আজকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দেখো নাই তোমার কপালে খারাপি আছে? এ কথার পর হাসি ধরে রাখার সাধ্য কার আছে? গণক সব গুছিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমরা কেন যে বুঝি না, যে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে না, দু’মুঠো খাবারের জন্য অন্যের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়, কোন আশায় আমরা তার মুখাপেক্ষী হই ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য!
এর সপ্তাহ খানেক পরের কথা। আসরের নামাজের পর আমরা কাছারি ঘরের সামনে দাড়িয়ে গল্প করছি। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে চিৎকারের শব্দ শুনলাম। দৌড়ে গিয়ে দেখি ভাতিজা নিজাম নারিকেল গাছের নিচে পড়ে আছে। প্রচণ্ড ব্যথায় ছটফট করছে। আমরা তার হাত পা টেনে সোজা করে দাঁড় করালাম। তার কাছ থেকে শুনলাম সে গাছের ডগা ধরে যখন ওপরে উঠতে যাবে, অমনি ডগাসহ ছিঁড়ে নিচে পড়ে গেলো। এ ঘটনার পর আমি ভয় পেয়ে গেলাম। যদিও ঘটনাটি কাকতালীয়। আমি কাউকে কিছু বলছি না, গণকের কথার সঙ্গে মিলিয়ে অতীতের ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো স্মরণ করার চেষ্টা করলাম।
আমরা যে অঞ্চলে বেড়ে উঠেছি, এখানে প্রায় প্রত্যেকটি শিশু হাঁটতে শেখার পাশাপাশি সাঁতারও শিখে যায়। এজন্য কোনো প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন হয় না। ন্যাচারলি বড়দের সঙ্গে পুকুরে গোসল করার সময় শিখে যায়। মাঝেমাঝে অঘটন যে ঘটে না, তা কিন্তু নয়। শিশুদের পানিতে ডুবে মরার ঘটনাও কম নয়। আমি এখনো পুরোপুরি সাঁতার জানি না। আমাদের পুকুর ঘাটের কিছু দূরে পূর্বপাশে পুকুরের দিকে ঝুঁকে পড়া একটা পেয়ারা গাছ ছিল। পেয়ারাগুলোর বিশেষত্ব ছিল, দানাগুলো বেশ নরম, খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু, পাকলে আকর্ষণীয় বর্ণ ধারণ করে। আমার বয়স তিন বছরের কোটায়। বর্ষাকাল, দুপুবেলা মেজো ভাইয়া (নুর আলম) পুকুর ঘাটে গোসল করছেন। পুকুরের দিকের যে ডালটি নিচু হয়ে প্রায় পানির সঙ্গে লেগে গেছে, সে ডালের মাথায় একটি পাকা পেয়ারা ঝুলে আছে। আমি যখন ডালের মাঝ বরাবর গেলাম তখন ডালটি আমার হাটু পানিতে। আমি যতই এগুচ্ছি ডালটি ততই তলিয়ে যাচ্ছে। আমি ওপরের একটি ডালে ভর করে নিচু হয়ে যখন পেয়ারাটি ধরতে যাবো, অমনি হাত ফসকে পুকুরের পানিতে পড়ে গেলাম। আমি পানির মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি। সর্বশক্তি দিয়ে পানির ওপর মাথা তুলে চিৎকার দিলাম। আবার তলিয়ে গেলাম। এভাবে দুই তিনবার করার পর আর উঠতে পারিনি। আমি নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছি আর প্রতিবারে পেটের মধ্যে পানি ঢুকছে। আমি ভাবছি, ভাইয়া আমাকে তুলছে না কেন? নাকি ভাইয়া আমার চিৎকার শোনেননি। আমার মনে হলো পুরো পুকুরের পানি আমাকে চেপে ধরেছে। আমি মরে যাচ্ছি। এমন সময় কারও পায়ের ধাক্কায় আমি কিছুটা সরে গেলাম। পুকুরের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমি আকাশে ওড়ার চেষ্টা করছি কিন্তু ঘুমের জন্য পারছি না। যখন ঘুম ভাঙলো আমি মেজো ভাইয়ার মাথার ওপর। আমার পেট বরাবর ভাইয়ার মাথা ঠেকিয়ে আমাকে উপুড় করে রেখে ভাইয়া ঘুরছেন। ভাইয়ার সঙ্গে আমিও ঘুরছি আর আমার নাক মুখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসছে। একদিনেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম। মা আমার নিরাপত্তার জন্য পুকুরে ভোগ দিলেন। একটা কলা পাতার মধ্যে ভাত, একটা আস্ত ডিম আরও কী কী দিয়েছেন আমার মনে নেই। এরপর পুকুরের মধ্যে ভাসিয়ে দিয়েছেন। বড় হওয়ার পর মায়ের মুখে শুনেছি, আমি হামাগুড়ি শেখার পর আমাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেন।
এর পাঁচ-ছয় মাস পরে তখন শরৎকাল শেষের দিকে। প্রায় দুইশ মণ ধান সিদ্ধ করা হয়েছে। তখন ধান সিদ্ধ করা হতো টিনের তাবায় খড়ের সঙ্গে তুষের আগুন দিয়ে। সমস্ত ছাইগুলো পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের একটা নারিকেল গাছের নিচে জমা করা হল। এই জায়গাটা হলো বাড়ির সমস্ত আবর্জনার ভাগাড়। কাজের বুয়ারা জ্বলন্ত ছাইয়ের ওপর পানি ছিটিয়ে দেওয়ায় আগুন ছাপা পড়ে যায়। এর পূর্বপাশে ছিল আমাদের সবজির ক্ষেত। সন্ধ্যার একটু আগে মায়ের সঙ্গে ক্ষেতে গেলাম। মা বেগুন তুলছেন। আমি বল খেলার জন্য বড় সাইজের একটা বেগুন হাতে নিয়ে ছাইয়ের স্তূপের পাশে এলাম। মা বিষয়টি খেয়াল করেননি। গনগনে ছাইয়ের স্তূপের মাজখান থেকে ধোঁয়া উঠছিল। আমি পাশে পড়ে থাকা কিছু শুকনো খড় নিয়ে যেই না ধোঁয়ার ওপর দেবো অমনি আমার কোমর পর্যন্ত ছাইয়ের চাপা আগুনের মধ্যে ঢুকে গেলো। আমার পরনের লুঙ্গি আর গায়ের জামায় আগুন ধরে গেলো। আমি চিৎকার দিয়ে পাশের পুকুরে নেমে গেলাম। আগুন নিভে গেলো কিন্তু ততক্ষণে বহিঃঅঙ্গ গলা পর্যন্ত ঝলশে গেছে। পেছনের দিকের চুলও পুড়ে গেছে। মা ছুটে এসে আমাকে কোলে নিয়ে বাড়ির উঠোনে একটা বড় ভাতের বলের মধ্যে বসালেন। চাচি-জেঠি সবাই যার ঘরে যত ডিম ছিল সব এনে আমার শরীরের ওপর লাগাতে লাগলেন। মা সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছিলেন। আমার নাভি পর্যন্ত ডিমের মধ্যে ডুবে গেলো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেছে। কান্না আসছে কিন্তু পারছি না। মনে হলো নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমার নাক মুখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। এরপর কী হলো জানি না।
এখনো সকাল হয়নি ফজরের আজানে আমার ঘুম ভাঙলো। আমি বেঁচে আছি। মনে অনেক জোর পেলাম কিন্তু আমার পিঠ যেন আটকে আছে। আমাকে কচি কলা পাতার ওপর শোয়ানো হয়েছিল। পিঠের পোড়া চামড়াগুলো তার সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছিল। আমি নড়তেই চামড়াগুলো শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছিল। কিছু পোড়া চামড়া আমার হাতের তালুতে লেগে আছে। কী বিভৎস! কোমর থেকে নিচের দিকে অসহ্য যন্ত্রণা করছে। আমি আস্তে করে মা বলতেই মা সাড়া দিলেন। মনে হয় মা সারারাত ঘুমাননি। অপেক্ষায় ছিলেন কখন আমি জেগে উঠি। বাবাও পাশের সিন্ধুকের ওপর ঘুমিয়েছিলেন। আমার কষ্ট দেখে বললেন, আর একটু ধৈর্য ধর। সকাল হলে তোর নবু (ডা. নবি উল্যাহ বাবার ভাগিনা) ভাইছা আইবো। ওষুধ দিলে ভালা অইযাইবি। বাবার কথা শুনে আমি ভরসা পেলাম। সত্যিই বাবারা সন্তানের দুনিয়া আর মা দুনিয়া ও আখিরাত। সন্তানের বিপদে বাবা কতটুকু ভরসার জায়গা আর মা শান্তির স্থান তা কেবল মা-বাবা হারা সন্তানেরাই ভালো জানে!
এর আগে আমায় দেখার পর সবাই বলতো বাঁচবে না মনে হয়। পাগলী দোয়া করার পর মনে হলো আমি আর মরবো না। কারণ আল্লাহ আমায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিয়েছে। ছয় মাসের মাথায় আমি পুরোপুরি সেরে উঠলাম কিন্তু গভীর ক্ষতগুলোর চিহ্ন এখনো আমায় সে ভয়ঙ্কর দিনটি স্মরণ করে দেয়।
সকালবেলা খুব ভোরে ডা. ভাইয়া এলেন। প্রথমে আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। দোয়া দরুদ পড়ে আমার শরীরে ফু দিলেন। আমার পায়ের গভীর ক্ষতগুলো ভালো করে দেখলেন। নিজের মুখে হাত রেখে অনেক্ষণ কী যেন ভাবলেন। এরপর আল্লাহ ভরসা বলে দু’হাতে ইনজেকশন পুশ করলেন। আমি একটুও ব্যথা পেলাম না। সম্ভবত ত্বক পুড়ে যাওয়ায় ব্যথার অনুভূতি মস্তিষ্কে যাচ্ছিল না। ক্ষতস্থানে লাগানোর জন্য মলম দিলেন। আমি মায়ের ঘরেই থাকি। পাশের রুমে আমাকে দেখতে আসা আত্মীয়রা পরস্পরকে বলছে, মা কেন ধরতে গেলেন? তখন একটা কুসংস্কার ছিল পানিতে পড়া সন্তানকে মা ধরলে সন্তান বাঁচে না। একবার ভাবুন তো মা যদি না ধরতেনম আমি তো পুকুরেই মারাই যেতাম। রোজ নিয়ম করে ডাক্তার ভাই আসেন আর আমাকে ইনজেকশন দেন। ক্ষতস্থান ড্রেসিং করে মলম লাগিয়ে দেন। প্রথম প্রথম ব্যথা না পেলেও এখন ইনজেকশন দেওয়ার সময় ব্যথা লাগে। আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। সুযোগ পেলে ডা. ভাইয়ের হাতে কামড় বসিয়ে দিতাম। ডা. ভাই কখনো রাগ করতেন না বরং সহানুভূতির সুরে বলতেন ছোটভাই একটু কষ্ট না করলে ভালো হবে কিভাবে? পরবর্তী সময়ে তিনি নতুন কৌশল নিলেন। সাগু দানার মতো মিষ্টি জাতীয় হোমিও বড়ি দেখিয়ে বলতেন চুপচাপ থাকলে প্রত্যেকদিন এক শিশি করে দেব।
প্রায় সপ্তাহখানেক পর বিকালবেলা আমাকে ঘরের বাইরে বাম দুয়ারের পাশে পেয়ারা গাছের ছায়ায় মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শোয়ানো হয়েছিল। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মাঝে মাঝে সাদা মেঘখণ্ড ভেসে যাচ্ছে। মা বলতেন মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়। মরে গেলে আমিও সাদা মেঘের ওপরে তারার দেশে চলে যাবো। আমি সেখান থেকে মা-বাবা সবাইকে দেখব। মা এখান থেকে আমাকে দেখবেন। কিন্তু দিনের বেলা তো তারা থাকে না। মা যদি রাতে বের না হন, তাহলে আমি দেখব কী করে? আমার মুখ বেয়ে চোখের পানি কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে বালিশের ওপর পড়ছে। সে সময়ে মাঝ বয়সী এক মহিলা আমাদের বাড়িতে মাসে দুই-চারদিন আসতেন। তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে পুল হাতা ব্লাউজ, এর ওপর চাদর টাইপের কিছু একটা জড়ানো থাকতো। দেখতে অনেকটা উপজাতীয় পোশাক মনে হতো। আসলে লজ্জা ঢাকার জন্য যখন যা পেতেন তাই গায়ে জড়িয়ে নিতেন। মাথার চুলগুলো পুরুষের মতো ছোট ছোট থাকতো।(হয়তো চুলের তেল সাবানের খরচ বাঁচাতে এ ব্যবস্থা)হাতে একটা বাঁশের লাঠি আর ভিক্ষার ঝুলি। সবাই পাগলি বলে ডাকতো।মুখে সব সময় আল্লাহ শব্দটা উচ্চারিত হতো। আমি তাকে আল্লাহ বলেই জানতাম। মা সব সময় তাকে খুব খাতির যত্ন করতেন। আমি পুড়ে যাওয়ার পর আজ তিনি প্রথম এসেছেন। আমার মাথার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই আমি বাস্তবতায় ফিরে আসি। এমন সময় মা এলেন। কান্না জড়িত কণ্ঠে আমার জন্য দোয়া করতে বললেন। পাগলি দু’হাত তুলে আমার জন্য দোয়া করলেন। আমি তার মুখ বেয়ে চোখের পানি পড়তে দেখেছিলাম। এর আগে আমায় দেখার পর সবাই বলতো বাঁচবে না মনে হয়। পাগলী দোয়া করার পর মনে হলো আমি আর মরবো না। কারণ আল্লাহ আমায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিয়েছে। ছয় মাসের মাথায় আমি পুরোপুরি সেরে উঠলাম কিন্তু গভীর ক্ষতগুলোর চিহ্ন এখনো আমায় সে ভয়ঙ্কর দিনটি স্মরণ করে দেয়।
চলবে..
আমার ছেলেবেলা-২