বিশ্বাস করুন, আর না করুন, বেশিরভাগ গণমাধ্যমকর্মীই সমাজের ভালোই চান। যে কারণে অসঙ্গঙ্গিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেন তারা। গবেষণা করে কোন অসঙ্গতির কারণে কী সমস্যা তৈরি হতে পারে। সে হিসেবে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সেসব বিষয়ে যুক্তি দিয়ে কথা বলারও চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের আগে যখন বিশ্বের বড়-বড় দেশ করোনা জ্বরে কাঁপছে, স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনো বুঝে উঠতে পারিনি, আমাদের কী হতে যাচ্ছে! যাই হোক কিছুদিন পরই সেই জ্বরের তাপ লাগতে শুরু করলো বাংলাদেশেও। আপাতত পুরো দেশের চিত্র নিয়ে কথা নাই বললাম। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে কাজ করছি নোয়াখালী জেলায়। তাই জেলার কিছু হালহকিকত নিয়ে কথা বলি।
এখানের গণমাধ্যমকর্মীরা শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, জেলাকে দ্রুত লগডাউন করতে। বিশেষ করে মার্চের মাঝামাঝি দিকে। প্রশাসনের বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রায় উত্থাপন করার পর ১১ এপ্রিল নোয়াখালীকে লকডাউন ঘোষণা করে প্রশাসন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তখন লকডাউন ঘোষণা করা হলেও তা মানাতে তেমন কঠোরতা দেখা যায়নি প্রশাসনের মধ্যে। জেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছিল। এছাড়া জেলা ও পুলিশ প্রশাসন থেকে ত্রাণ দিয়েছিল। যে অর্থে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল, তা কার্যত শূন্যের কোঠায় ছিল।
তবে মুদি, ফার্মেমি ও বিভিন্ন পরিষেবা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার কথাও বলা হয়। প্রশাসনের এমন ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
অভিযোগ ছিল পুলিশের সদস্যরা উৎকোচ নিয়ে দোকান খুলতে ও গাড়ি চলাচলে সুযোগ করে দিয়েছিলেন। জেলা ও উপজেলা সীমান্ত চেকপোস্টও বসিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। পুলিশের অসহযোগিতায় তখন চেকপোস্ট তেমন একটা কাজ করেনি। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচিতও হয়েছিল প্রশাসন। সমালোচনাকে ঢাকতে শেষের দিকে প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসে। ঠিক সে সময় সরকারিভাবেই সিদ্ধান্ত এলো সীমিত পরিসরে রমজান ও ঈদুল ফিতরে দোকানপাট খোলা রাখার। এমন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হুড়হুড় করে মানুষের ঢল নামতে শুরু করলো শহরে।
যখনই দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্ত এলো, তখনই বাড়তেও শুরু করলো সংক্রামণও। পুরো দেশের মতো বাড়তে শুরু করে নোয়াখালীতেও। প্রথম দিকে সংক্রমিতের হার কম দেখা যায়। যখনই জেলার দুটি ল্যাবে করোনা পরীক্ষা শুরু হলো, তখনই সংক্রমিতের হারও বাড়তে দেখা গেলো। এর কারণ হিসেবে অনেকের ধারণা নোয়াখালীর নমুনা চট্টগ্রাম পাঠানো হলেও তখন তারা অল্প সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করতো, যার কারণে জেলার সংক্রমিতের হার কম দেখা গেছে। যখনই জেলায় করোনার নমুনা পরীক্ষা শুরু হলো, তখনই বোঝা গেলো জেলায় কী পরিমাণ সংক্রমিত হচ্ছে। এ লেখা যখন লিখছি, তখন সরকারিভাবে জানা গেলো (১৫ মে) নোয়াখালীতে ৯৮জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরই বেশি বেগমগঞ্জ উপজেলায়।
গত এক সপ্তাহে হু-হু করে যখন জেলায় সংক্রমিতের হার বড়ছিল, তখন আবারও গণমাধ্যমকর্মী, সচেতন মহল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেলাকে পুনরায় লকডাউন ঘোষণার জন্য আওয়াজ উঠতে থাকে। এর মধ্যে নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী তার ফেসবুক থেকে লাইভ দিয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জনকে অনুরোধ জানান, জেলাকে পুনরায় লকডাউন করতে। এক পর্যায়ে বৃহস্পতিবার (১৪ মে) জেলা প্রশাসক (জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি) তন্ময় দাস স্বাক্ষরিত একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে শুক্রবার (১৫ মে) সকাল ৬টা থেকে পুনরায় জেলার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে মুদি, ফার্মেমি ও বিভিন্ন পরিষেবা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার কথাও বলা হয়। প্রশাসনের এমন ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
তবে, প্রশ্ন উঠেছে এবার ঘোষিত লকডাউন কার্যকর করতে প্রশাসন কঠোর হবে তো? নাকি প্রথম বারের মতো শুধু ঘোষণা করে বসে থাকবে? যদি আগের মতো ঢিলেঢালা হয়, তাহলে এ লকডাউন ঘোষণা করে কোনো লাভ হবে না; কমবে না সংক্রমণও। যদি জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও স্বাস্থ্য প্রশাসন যৌথভাবে মাঠে কাজ করে, তাহলে হয়তো কমানো যাবে করোনা সংক্রামণ। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা আরও সক্রিয় হতে হবে।
ভালোই ভালোই করোনা পরিস্থির উন্নতি হলে মানুষের চিন্তা-চেনতনারও কিন্তু বেশ পরিবর্তন হবে। আর এর প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে। আশা করি, এবার নোয়াখালীর লকডাউন সত্যি সত্যি কার্যকর হবে।
বলা অবান্তর হবে না, করোনা সময়ে বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। অনেক জনপ্রতিনিধি নিজেই ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন। আবার হাতেগোনা দু-চারজন মাঠে থেকে ত্রাণ দেওয়ার পাশাপাশি জনসাধারণকে সচেতন করার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা মনে করি, এখনো সাধারণ মানুষের আস্থা প্রশাসনের চেয়ে জনপ্রতিনিধিদের ওপর বেশি। সেক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা যদি নিজ এলাকায় বাইরে গিয়ে হাতে মাইক তুলে নেন, মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাহলে লকডাউন আরও বেশি কার্যকর হবে। তবে একটা বিষয় বেশি খেয়াল রাখতে হবে, তা হচ্ছে মানুষের খাদ্যের জোগান দেওয়া। সরকার বার বার বলছে, দেশে তথা সরকারের কাছে খাদ্য সামগ্রী বেশ মজুদ রয়েছে। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে জনপ্রতিনিধিরা আশ্বস্ত করতে হবে যে, তাদের ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছে যাবে। ওয়ার্ডভিত্তিক ত্রাণ কমিটিগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তারা প্রত্যেকে এলাকায় প্রথমে যারা নিম্নআয়ের মানুষ, যারা দিন মজুর তাদের তালিকা করে মাসিক খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে। পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে। না হয় এ লকডাউন কার্যকর হবে না। একইসঙ্গে না খেয়ে মরতে হবে অনেককে।
স্ব-স্ব এলাকার সংসদ সদস্যদের বেসরকারি হাসপাতাল ও সরকারি হাসপাতালে খবর নিতে হবে, করোনার ভয়ে যেন অন্য স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয় সাধারণ মানুষ। ডাক্তার ও হাসপাতাল মালিকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে হবে জনপ্রতিনিধিদের। তাদের বোঝাতে হবে, না বুঝলে বাধ্য করতে হবে মানুষকে সেবা দিতে। এক কথায় জনপ্রতিনিধিদের অনেক বেশি পরিমাণ ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ সাধারণ মানুষের কাছে প্রশাসনের চেয়ে বড় দায় রয়েছে জনপ্রতিনিধিদের। এই সাধারণ মানুষের ভোটেই তারা জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। করোনা-উত্তর মানুষ এ হিসাব কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেবে। ভালোই ভালোই করোনা পরিস্থির উন্নতি হলে মানুষের চিন্তা-চেনতনারও কিন্তু বেশ পরিবর্তন হবে। আর এর প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে। আশা করি, এবার নোয়াখালীর লকডাউন সত্যি সত্যি কার্যকর হবে।
লেখক: সাংবাদিক