বছরের প্রায় মাঝামাঝি সময় হবে। আমার কর্মকাণ্ডে সবাই অস্থির, কাজেই স্কুলে পাঠাতে হবে। রাতে মা যখন বললেন, আগামী দিন তোর বাবা তোকে ভর্তি করাতে স্কুলে নিয়ে যাবেন, তখন আমার সেই কী আনন্দ! আনন্দের বিশেষ কারণ ছিল নতুন জামা-লুঙ্গি।
সকালে বাবার হাত ধরে বাড়ির দক্ষিণ পাশে মমতাজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত। বুদ্ধির পরীক্ষা নিয়ে তবেই ভর্তি। ভয় পাচ্ছিলাম, তবে বাবা আমাকে সাহস জোগাচ্ছিলেন।
আমাকে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছায়েদল হক স্যারের রুমে নিয়ে গেলেন বাবা। স্যার নাম জিজ্ঞেস করলেন। মাথার ওপর দিয়ে পর্যায়ক্রমে ডান হাত দিয়ে বাম কান আর বাম হাত দিয়ে ডান কান ধরতে বললেন। এটা যে করতে পারে, ধরে নেওয়া হয় তার বুদ্ধি হয়েছে। এই পরীক্ষায় পাস করলাম। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। কী সহজ ছিল প্রাথমিকের ভর্তিপরীক্ষা-পদ্ধতি। এ সময়ের ভর্তি পদ্ধতি দেখে মনে হয়, ভর্তির আগে বাড়ি থেকে সব শিখিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। স্কুলের কাজ শুধু পরীক্ষা নেওয়া। প্রশ্ন হলো, তাহলে স্কুলের কী কাজ?
প্রায় এক সপ্তাহ পর প্রধান শিক্ষক আমাদের ৫-৬ জনকে তার রুমে ডাকলেন। পরীক্ষা নেবেন। কী বিপদ! ভর্তি বাতিল হবে না তো? আমাদের নিজের নাম, মা-বাবার নাম, দেশের নাম, জাতীয় ফুলের নাম, জাতীয় পাখির নাম, এমন আরও কিছু প্রশ্ন করলেন। আমরা নির্দেশনা মতো লিখলাম। এই দলে ভাগিনা আসাদ, আসাদের প্রতিবেশী সেলিমও ছিল। বাকিদের কথা ঠিক মনে পড়ছে না। আমরা সবাই পাস। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্যার যখন ঘোষণা দিলেন, ‘বেশ বেশ তোমরা বড় ওয়ানে চলে যাও’, ওই সময়ের অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। হয়ে গেলো এক বছরে দুই ক্লাস।
উল্লেখ্য তখন প্রাক প্রাথমিক ছিল না।
এভাবে প্রতি মাসে আমার জন্য বাবাকে দু’ একবার স্কুলে যেতে হতো, স্যারের নিকট জবাবদিহিতার জন্য। এটা একজন বাবার জন্য কতটা লজ্জা আর কষ্টের এখন বুঝি। কখনো পেট ব্যথা, কখনো মাথাব্যথা, কখনো বড় আম গাছের মগডালে লুকিয়ে থেকে স্কুল ফাঁকি দিতাম।
আমাদের সহকারী শিক্ষক ছিলেন, আবু তাহের, আবুল বাশার, একজন হিন্দু স্যার (নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, তবে তার কথা মনে হলে আমার কানটা এখনো লাল আর গরম হয়ে যায়। ভালো হয়েছে নামটা ভুলে গেছি)। আমাদের শিক্ষকরা খুব বড় ডিগ্রিধারী ছিলেন না, তবে তাদের আন্তরিকতা আর চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে আমাদের ভেতর উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করতেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিতেন আমার বড় ভাই অধ্যাপক বদিউল আলম, জেঠাতো ভাই আলা উদ্দিন। এখন শিক্ষকতা পেশায় এসে বুঝছি, সামান্য যতটুকু পথ পাড়ি দিয়েছি, তার প্রধান জ্বালানি ছিল তাদের শাসন, আদর আর স্নেহভরা উৎসাহ।
২য় শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় আমাদের যে হিন্দু স্যার ছিলেন, তিনি আমাদের বাড়িতেই লজিং থাকতেন। রাতে বড় জেঠাদের পরিবারের স্কুলগামী ছেলে-মেয়েদের পড়াতেন। তার ভয়ে রাতের লুডু খেলার আসরটা বন্ধ। সকালে মক্তব থেকে এসে কোনো রকম খেয়ে পুকুরে কাউ-কাউ খেলতাম তাও বন্ধ। বিকেলের মনদুরুজ খেলা, ডাঙগুলি খেলা, তাও বন্ধ। বন্ধ বন্ধ বন্ধ। স্কুলে গেলে হাতের লেখার জন্য খুব মারতেন (চিড়লি গাছের বেত দিয়ে)। সময় নিয়ে সুন্দর করে লেখার মতো ধৈর্য ও যোগ্যতা কোনোটিই আমার ছিল না। আমার হাতের লেখা মাঝেমাঝে নিজেও পড়তে কষ্ট হতো। প্রতিদিন মার হজম করার পাত্রও আমি নই। স্যারের ওপর খুব রাগ হলো। স্কুলে যাওয়ার আনন্দটা মাটি হয়ে গেলো। বাড়িতেও স্যারের জ্বালায় অতিষ্ঠ। সিদ্ধান্ত নিলাম স্কুলেই যাব না।
পড়ালেখায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য এমন কোনো কৌশল ছিল না, যা আমি করিনি। বিদ্যালয়ের ঘণ্টার ধ্বনি আমাদের বাড়ি থেকে শোনা যেতো। যখন ঘণ্টা বাজতো, মনে হতো শিক্ষক বনাম শিক্ষার্থীর মধ্যে যুদ্ধের সানাই বাজছে। আমি প্রথম প্রথম ঘণ্টার আওয়াজ পেলে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতাম। মা কারণ জানতে চাইলে বলতাম পেট ব্যথা। মা এক চামচ জৈতুন তেল মুখে দিয়ে বলতেন, সারাদিন পুকুর পাড়ে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াছ, পেটের মধ্যে সুজা ঢুকছে। নে, খেয়ে নে, ভালো হয়ে যাবে। এরপর চোখ, কান আর নাকেও লাগিয়ে দিতেন। জৈতুন তেল গিলা খুব কষ্টের ছিল কিন্তু তার চেয়ে হিন্দু স্যারের বেতের আঘাত ছিল আরও কষ্টের। ঘণ্টা দুই পরে আমি এমনি এমনি ভালো হয়ে জেতাম। মা কিন্তু টের পেয়ে গেলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, এভাবে স্কুলে না গেলে স্যার আরও বেশি মারবেন। আমি বলতাম, আমি আর স্কুলে যাবো না, স্যার আমাকে মেরে ফেলবেন। মা অভয় দিয়ে বলতেন তোর বাবাকে বলবো, হাতে করে নিয়ে যেতে। এভাবে প্রতি মাসে আমার জন্য বাবাকে দু’ একবার স্কুলে যেতে হতো, স্যারের নিকট জবাবদিহিতার জন্য। এটা একজন বাবার জন্য কতটা লজ্জা আর কষ্টের এখন বুঝি। কখনো পেট ব্যথা, কখনো মাথাব্যথা, কখনো বড় আম গাছের মগডালে লুকিয়ে থেকে স্কুল ফাঁকি দিতাম।
ছোটকালে আমার শরীরটা বিশ্রী ধরনের ভালো ছিল। এত আজেবাজে খাবার খেয়েও ডায়রিয়া হতো না, সকালে গোসল করতে নেমে সম বয়সীদের নিয়ে অনেকক্ষণ কাউকাউ খেলতাম। কখনোও সর্দিকাশি হয়নি। শীতকালে কুয়াশার মধ্যে খুব ভোরে ডাহুক ধরার জন্য ফাঁদ বসাতাম, গায়ে ঠাণ্ডা লাগেনি। এখন ডাস্ট এলার্জি, কোল্ড এলার্জি, খাবার একটু এদিক-সেদিক হলে ডায়রিয়া কোনোটির কমতি নেই। মন্টিলুকাস আমার নিত্য সঙ্গী। স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল এখন আমাকে কেউ শেখাতে হয় না।
ঘরে চল ভাই। আমি ভাইয়ার সেই কণ্ঠে বেদনা আর কান্নার সুর শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম পৃথিবীর সব ভাইয়াদের শাসন এমন সুমধুরই হয়।
হিন্দু স্যার যখন ট্রান্সপার নিয়ে চলে গেলেন। আমার সুদিন শুরু হল। আমি আমার ইচ্ছামতো পড়াশো খেলাধূলা করে সময় কাটাতাম। বাবা কখনো আমার কোনো বিষয়ে দ্বিমত করতেন না। মাঝেমাঝে বড় ভাইয়ারা ঝামেলা করতেন। হানা দিতেন আমার স্বৈরতান্ত্রিক রাজ্যে। মেজো ভাইয়া আর সেজো ভাইয়াকে একটু ভয় পেতাম। একদিন আমার সেজো ভাই (খুরশিদ আলম) বাড়িতে এসে যখন দেখলেন আমি স্কুলে যাইনি অমনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে আমাকে তাড়া করলেন। ছোট চাচাদের ঘরের পেছনে বরই গাছের কত কাঁটাযুক্ত ডাল স্তূপ করে রাখা ছিল। আমি যখন দৌড়ে পারছিলাম না, ঝাঁপ দিলাম ওই কাঁটার ওপর। ভাইয়া তাড়াতাড়ি আমার ক্ষতবিক্ষত দেহটা কোলে করে ঘরে নিয়ে এলেন। এই ঘটনার পর ভাইয়ারা আর ঝুঁকি নেননি।
পঞ্চম শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। আমার পড়ার তেমন চাপ নেই। সামনে পঞ্চম শ্রেণীর সরকারি বৃত্তি পরীক্ষা। মাঝেমাঝে পুরনো পড়াগুলো দেখি। এর মধ্যে বদিউল ভাইয়া এলেন বাড়িতে। আমাকে নিয়ে পড়তে বসলেন। পড়াশুনার খবর জানতে চাইলে আমি বললাম সব শেষ। গণিতের টেস্ট নিলেন। এরপর অন্যান্য বিষয়গুলো দেখলেন। আমাকে বললেন, বৃত্তির জন্য আরো ভালো করে পড়তে হবে। আমাকে ঘণ্টাখানেক পড়ার জন্য বললেন। আমি বললাম আমাকে বইয়ের একটা অংশ দিতে। ভাইয়া বাংলা বইয়ের পদ্যাংশ পুরোটা দিলেন। আমি কিছুক্ষণ বইটা উল্টিয়ে দেখে বললাম আমি পারবো। ভাইয়ার টেস্টে আমি যখন পাশ, তখন ভাইয়া বললেন সবেমাত্র সাড়ে সাতটা আর কিছুক্ষণ পড়। আমি বললামম আমার সঙ্গে কন্টাক্ট যেটা সেটাতো শেষ, আমি আর পড়বোনা। ভাইয়া অনেক বোঝানোর পরও আমাকে যখন রাজি করাতে পারলেন না, তখন রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হঠাৎ আমার বাম গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন, যার জন্য আমি কখনো প্রস্তুত ছিলাম না। এটাই ভাইয়ার প্রথম এবং শেষ শাসন। আমি কিছুক্ষণে জন্য কী করবো, বুঝে উঠতে পারিনি। লজ্জা আর অভিমানে হঠাৎ টেবিল থেকে উঠে দৌড়ে ঘরের পেছনে বাসক গাছের আড়ালে লুকালাম। ততক্ষণে বাবা টের পেয়ে গেলেন। ভাইয়াকে বকাবকি করে বলতে লাগলেন, ‘হেতে হত্তিদিন নিজে নিজে হনা।ওডা তুই নতুন মাস্টর ওইচত।হেতে না হইলে এক নম্বরে পাস করে কেন্নে?’
আমি যখন ভাইয়ার ঘর থেকে বের হওয়ার শব্দ পেলাম, দেরি না করে সোজা দৌড় দিলাম বাড়ির দরজার দিকে। ভাইয়া টর্চলাইট নিয়ে আমার পেছনে অনেকটা দূরে থেকে দৌড়াচ্ছেন। আমি দ্রুত কবর স্থানের জঙ্গলে বাদিগাছের নিচে বসে পড়লাম। ভাইয়া আমার নাম ধরে ডাকছেন আর লাইট মেরে খুঁজছেন। লাইটের আলো আমার মুখে পড়তেই ভাইয়া জঙ্গলে ঢুকে আমার হাত ধরে বললেন, আর কখনো তোকে মারবো না। এখানে বড়বড় সাপ আছে। ঘরে চল ভাই। আমি ভাইয়ার সেই কণ্ঠে বেদনা আর কান্নার সুর শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম পৃথিবীর সব ভাইয়াদের শাসন এমন সুমধুরই হয়।
চলবে…