অন্যান্য সাহিত্য

জীবনের যতিচিহ্নগুলো-১৩


[পর্ব-১৩: প্রাইমারি স্কুল পর্ব]

ছোট খালাকে তীরবিদ্ধ করার পর ভয়ে অনেক দিন আর তাদের বাড়িমুখো হইনি। স্কুল থেকে ফিরে এসেই চলে যেতাম বেড়িবাঁধের কাছে। বাংলাবাজার থেকে পূর্বদিকে সেই বেড়িবাঁধ। বেড়িবাঁধ থেকে নদী সরতে সরতে বহু পূর্বদিকে চলে গেছে। একদা প্রমত্তা দুই মাইল চওড়া নদীকে দেখলাম কিভাবে নালার মতো সরু হয়ে যেতে। এই নদীতে একদা দেখেছি শয়ে শয়ে পালতোলা সাম্পান। কতদিন সকালে ঘুম ভেঙেছে স্বজন হারানোর আহাজারিতে। কী হয়েছে, কী হয়েছে—জানতে চাইলে ঘোমটার নিচ থেকে স্বজনহারানো নারীরা তাদের স্বামী কিংবা বাবা কিংবা ভাইয়ে সলিলসমাধির খবর দিতে দিতে রোনাজারি করেছেন। সেই নদী ধীরে ধীরে সরু হতে থাকলো। বাড়তে থাকলো চরের পরিধি। নদী চলে যেতে লাগলো দৃষ্টিসীমা থেকে বহুদূরে। বাড়ির পাশের ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা পূর্বদিকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকলো। নদী হতে থাকলো আরও ক্ষীণতনু। এতই ক্ষীণ যে নদীর দুই পাশে লোহার খুঁটিতে বাঁধা রশি ধরে টেনে টেনে খেয়াপারাপার হতো। আমাদের হাতে নগদ পয়সা থাকতো না। বাড়ি থেকে কখনো ডালিম, কখনো পেয়ারা নিয়ে যেতাম। সেই পেয়ারা-ডালিম দিলেই খেয়ার মাঝি আমাদের পার করে দিতেন।

উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের রেডক্রিসেন্টের কেল্লা কিংবা সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নিতে। কিন্তু কেল্লা কিংবা সাইক্লোন শেল্টার কোনোটাই আমাদের বাড়ির কাছাকাছি নয়। অনেক দূরে।

একসময় সেই নৌকাও উঠে গেলো। অতিকায় লোহার ‘পাইপ’ পড়লো নদীতে। সেই পাইপ চোখের সামনেই বানালো মিস্ত্রিরা। মোটা নাটবল্টু দিয়ে পাইপের একেকটা পাতের সংযোজন হলো আমাদের চোখের সামনেই। আমাদের চোখ চিক চিক করতো একটি নাটবল্টু কোনোভাবেই সরানোর জন্য। কেউ কেউ সুযোগ বুঝে সরিয়েও নিয়ে আসতাম। সেই সব নাটবল্টু আবার কেউ কেউ বাজারে মুদি দোকানির কাছে বিক্রি করে দিতাম। মুদি দোকানদার এক ছটাক, দুই ছটাক কিংবা একপোয়া ওজনের বাটখারার পরিবর্তে এই নাটবল্টুর ব্যবহার করতেন।

ওই লোহার পাইপ একদিন নদীতে পড়লো। পাইপের ওপর টনকে টন পড়লো মাটি। মানুষকে আর নদীর চড়া দিয়ে পার হতে হয় না। না কোনো খেয়ার নৌকারও প্রয়োজন হয় না। এভাবেই চললো বেশ কিছু দিন।

তখন বর্ষা এসে গেছে। টানা চৌদ্দ দিন অবিরাম বৃষ্টি। সারাগ্রাম জলে থই থই। লোকজন বলাবলি করছে, ইন্ডিয়ার যেন কোন বাঁধ ভেঙে গেছে, কেউ কেউ বলছে খুলে দিয়েছে। ইন্ডিয়ার পানি ও বৃষ্টির পানি মিলেমিশে একাকার। অনেকেরই বাড়িঘর ডুবে গেছে। কারও কারও গোয়ালঘরের চাল ছুঁই-ছুঁই পানি। তারা গরু নিয়ে জেলাবোর্ডের রাস্তায় হাজির।

একদিন শেষ রাতের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। দেখি আমাদের চৌকির নিচে পানি। বাইরে প্রচণ্ড ঝড়। গাছপালা মড়মড় করে ভেঙে যাচ্ছে। বাবা দরোজার কপাট শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। ক্ষণে ক্ষণে জিকির করছেন। প্রচণ্ড ঝড়ে যেন ঘর উড়ে যাবে। ঘরের পালাগুলো কড়মড় করে যেন ভেঙে যাচ্ছে। হঠাৎ পূর্ব দিক থেকে ‘আঁ-আঁ-আঁ’ শব্দ ভেসে এলো। এমন বিকট শব্দ আর কখনো শুনিনি। এই শব্দে মা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে-কেঁদে উঠলেন। আর বাবা কিছুক্ষণ পরপর আজান দিয়ে যাচ্ছেন। চালিয়ে রেখেছেন নিজের তিন ব্যান্ডের রেডিওখানাও। রেডিওতে ক্ষণে ক্ষণে আবহাওয়ার বুলেটিন দিচ্ছে। বলছে উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের রেডক্রিসেন্টের কেল্লা কিংবা সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নিতে। কিন্তু কেল্লা কিংবা সাইক্লোন শেল্টার কোনোটাই আমাদের বাড়ির কাছাকাছি নয়। অনেক দূরে। গ্রামে ঢলের পানি এত বেশি যে বয়স্কদেরও সাঁতার কেটে এই বাড়ি ওই বাড়ি করতে হচ্ছে।

মুহূর্ত মাত্র কী যেন ভাবলেন। তারপর দূর থেকে বাঁশের লগির ঠেলায় পাড় থেকে লাশ দুটিকে নামিয়ে দিলেন বিশাল জলরাশিতে। বঙ্গোপসাগরের দিকে। যে দিক থেকে জোয়ারের সর আসে, আবার ভাটার টানে নেমে যায় পানি—আজ এই লাশ সেদিকে ভেসে চললো। মা-সন্তানের এমন লাশ দেখে আমি আঁৎকে উঠেছি।

সকাল হতেই বাতাসের গতি কমতে থাকলো। তবে বাতাস খুব ঠাণ্ডা। হালকা বৃষ্টি ঝরছে। হঠাৎ ছলাৎ ছলাৎ শুনে ঘরের দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে দেখি, মরিয়ম, হাসান ভাই ও তাদের মা আসছেন কলাগাছের বিশাল ভেলায় চড়ে। যেন ভিজে যান, সেজন্য ভেলার ওপর চিৎ করে চৌকি বিছিয়ে দিয়েছেন। আর হাসান ভাই লম্ব বাঁশের লগি ঠেলে ঠেলে সেই ভেলাকে এনে ভেড়ালেন আমাদের ভিটির সঙ্গে। সঙ্গে করে নিয়ে এলেন গরম ভাত, মাছ দিয়ে রান্না করা আলুর তরকারি। আমার মাকে মরিয়মের মা বললেন, ‘নেও। সারারাত আল্লাহরে ডাইকছি। পেটে দানাপানি কিচ্ছু দিই নাই। তোমার আবু দুডার লাই কলজেটা জ্বললো গো। অনেক কষ্টে রান্না করছি। নেও আগে সবাই মিলে খাই। সবাই একলগে থাকি। আল্লাহই যা করে করইবো। বাঁচলে একলগে বাঁচমু, মরলে একলগে মরমু।’

তখনো আমাদের ঘরের পানির স্রোত। তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা চৌকি আমাদের ঘরের মাঝখানে বসানো হলো। আমাদেরটাসহ এখন দুটি চৌকি। একটিতে হাসান ভাই, বাবা ও আমরা দুই ভাই। অন্যটিতে মা, মরিয়রের মা ও মরিয়ম।

সবাই খেতে বসেছি। এমন সময় হাসান ভাই বললেন, ‘কাকা হুইনছেননি? রাইতে যে আঁ-আঁ-আঁ শব্দ অইছিল?’ বাবা বললেন, ‘হুইনছি তো। কিয়ের শব্দ? তুই জানোসনি?’ হাসান ভাই বললেন, ‘হ্যাঁ কাকা। লোহার পাইপের ওপরের বাঁধ ছিঁড়ি গেছে। ওই শব্দ হুইনছেন।’ শুনে মা বলেন, ‘ও জাদু কী কস? তোই আমরা চরলক্ষ্মী-টক্ষ্মী যামু ক্যামনে?’ হাসান ভাই বলেন, ‘চাচি আন্নে কীআ কন? বাঁধ ছিঁড়ি যাওনে তো ভালা অইছে। দেইখছেননি কত তারাতারি পানি নামি যাইতেছে? আল্লাহই যা করে ভালার লায়ই করে।’

সেদিন বিকাল হতে হতে পানি কমতে থাকে। তখন কেবল উঠোনে পানি। হাসান ভাই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তার ভয়ার্ত চিৎকার ভেসে এলো—‘কাকা গো। আম্নে এই দিকে আইয়েন।’

‘কী অইছে রে?’ বলতে বলতে পুকুরের দক্ষিণ পূর্বপাড়ে গিয়ে হাজির হলেন বাবা। আমরা দুই ভাইও গেলাম পেছন পেছন। ইয়া আল্লাহ! এই কী দেখলাম। আমার মায়ের বয়সী এক নারীর লাশ। শিশুসন্তানের লাশ বুকের সঙ্গে আঁচল দিয়ে বাঁধা। পুকুর পাড়ে এসে ভিড়েছে। বাবা বললেন, ‘কী করমু হাসান?’ হাসান ভাই কোনো কথা বলেন না। হাতে বাঁশের লগি। মুহূর্ত মাত্র কী যেন ভাবলেন। তারপর দূর থেকে বাঁশের লগির ঠেলায় পাড় থেকে লাশ দুটিকে নামিয়ে দিলেন বিশাল জলরাশিতে। বঙ্গোপসাগরের দিকে। যে দিক থেকে জোয়ারের সর আসে, আবার ভাটার টানে নেমে যায় পানি—আজ এই লাশ সেদিকে ভেসে চললো। মা-সন্তানের এমন লাশ দেখে আমি আঁৎকে উঠেছি। একে তো ঠাণ্ডা হাওয়া, তার ওপর লাশের দৃশ্য, দুটো মিলে আমার পা দুটো কাঁপছে ঠকঠক করে। ঠোঁটজোড়াও কাঁপছে। কণ্ঠ আমার বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এসেছে। বিষয়টি হয়তো বাবা বুঝতে পেরেছেন। বললেন, চল ঘরে যাই।

ওই তো আমাকে নিতে নীল-সিয়া আসমান থেকে কারা ঝাঁকে-ঝাঁকে যেন নেমে আসছে। আমার দুই চোখের চারপাশে রঙধনুর সাতরঙ মাখা লাখ-লাখ তারা যেন জ্বলে উঠলো আর  তখনই দুইচোখ জুড়ে যেন নেমে আসছিল নিবিড় ঘুম।

বানের পর নদীর পশ্চিম পাড়ে রাস্তার দুই পাশে শত শত লাখ আটকে ছিল। পরে বেওয়ারিশ হিসেবে রাস্তার দুই পাশে ওই লাশ দাফন করা হয়েছিল। শুনেছি একই কবরে নাকি তিন-চার জনকে দাফন করা হয়েছে। দাফন করার আগে নাকি ঝাঁকে-ঝাঁকে ‘গুল্লা মাছ’ সেই সব লাশ ঠুকরে ঠুকরে খেয়েছে। অনেকেই নাকি দেখেছেও।  সেই বানের বছর গুল্লা মাছ আর কেউ ধরতো না। কারও জালে ধরা পড়লেও কেউ খেতো না। বাজারে তুলতো না। ইলিশ ছাড়া অন্য কোনো মাছ বাজার থেকে কেউ কিনতে চাইতো না। যদিও বা কেউ কিনতো, খুব গোপনে বাড়ি নিয়ে আসতো। কাউকে শোনাতো না।

ওই বছর অথবা তারও কিছুদিন পর ওই লোহার পাইপের খানিকটা পূর্বপাশে স্লুইস গেট বসানো হয়। এরপর স্থায়ীভাবে নদী হয়ে পড়ে একেবারে সরু নালা। তার আর আগের সেই প্রমত্তা ভাব নেই। আগের মতো সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে দুকূল প্লাবিত করে নদীতে সাঁ-সাঁ সর আসে না। নৌকাও ভাসে না। ঢেউ-ঢেউ জলরাশির জায়গায় এখন স্থানে স্থানে কাঁশবন। তৈরি হতে থাকলো নতুন নতুন বাড়ি। মাঝে মাঝে জিপ দেখা যায়। প্রায় পিপ-পিপ শব্দ করে মোটরসাইকেল চলে। শীতকাল এলে চলে বাসও। রাস্তায় ধুলো উড়ি বাস ছুটে চলে। আমরা ছোটরা দৌড়াই সেই বাসের পেছনে। বাসের পেছনের সিঁড়ি ধরে ঝুলতে থাকি সিকি মাইল পথ।

একবার রাস্তার পাশে খেলছিলাম। আমার হাতে মাটির কলসের ভাঙা কাঁধ। এটি গোল চাকার মতো। কলমির ডাল ভেঙে ত্রিকোণ বানিয়ে সেই ডাল দিয়ে ঠেলে ঠেলে চালাতে হয়। সেদিনও আমরা কয়েকজন আমাদের সেই চাকার গাড়ি চালাচ্ছিলাম। পূর্বদিক থেকে ছুটে আসবে বিশাল বাস। বাসের হর্নের শব্দে নিজেরা সরে গেলেও আমাদের চাকাগুলো রক্ষা করতে পারিনি। বাস পাশ দিয়ে পার হয়ে যেতে না যেতেই আমরাও পিছু নিলাম। সামনে খানাখন্দ বেশি। বাসেরও গতি কমলো। দৌড়ে ধরে ফেললাম। পেছনের সিঁড়িতে তিন জন ঝুলছি। ছাদের ওপর ছিল কয়েজন। তাদের একজনের হাতে ছিল লাঠি। সে লাঠি দিয়ে আমাদের আঘাত করার ভয় দেখাচ্ছিল। বাসের গতি বাড়লো দ্বিগুণ। লোকটির ভয় দেখানোর মাত্রা গেলো গেলো। সেদিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ হাত ফসকে গেলো। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম রাস্তায়। চারদিকে ধুলিঝড়। কিছুই দেখছি না। কিছুক্ষণ পর উঠে বসতেই নাকের ভেতর কেমন নোনতা স্বাদ অনুভব করলাম। নাক ধরতেই মনে হলো হাত ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু ধুলির কারণে কিছুই দেখতে পেলাম না। কেবলই মনে হচ্ছিল, আমি শেষ। আর বাবা-মাকে দেখতে পাবো না। ছোট ভাই ইসমাইলের সঙ্গে পেয়ারা নিয়ে আর খুনসুটি করতে পারবো না। দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ওই তো আমাকে নিতে নীল-সিয়া আসমান থেকে কারা ঝাঁকে-ঝাঁকে যেন নেমে আসছে। আমার দুই চোখের চারপাশে রঙধনুর সাতরঙ মাখা লাখ-লাখ তারা যেন জ্বলে উঠলো আর  তখনই দুইচোখ জুড়ে যেন নেমে আসছিল নিবিড় ঘুম। কেবল অতিদূর সমুদ্র থেকে ঝড়ো হাওয়া উজিয়ে যেন ইসমাইলের কান্নাভেজা ডাক ভেসে আসছিল, ‘ভা-ই-ছা।’

চলবে…

জীবনের যতিচিহ্নগুলো-১২

মন্তব্য