অন্যান্য সাহিত্য

জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৭


[পর্ব-৭: মাদ্রাসা পর্ব]

বাড়ি ফিরে ঘরের সামনে দাঁড়ালাম মাত্র। মা বললেন, এত বেহেন্না কই গেছিলি? আমি নিরুত্তর। কী বলবো, বুঝে উঠতে পারছি না। রক্ষাকর্তা হয়ে এলো ইসমাইল। বললো, মরিয়মগো বাড়িত গেছে। ‘কিল্লাই’ বলে মা প্রশ্ন শেষ করার আগেই ইসমাইলের জবাব, ভাইছা তো নির্বাচন কমিশনার অইবো। মরিয়ম হেতারে নির্বাচন কমিশনার বানাইবো। আর জানেননি? হেতে কিন্তু জানেই না, নির্বাচক কমিশনার কী? এইটা জানতে মরিয়মগো বাড়িত গেছে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আমার দিকে তাকালো সে, ‘কিরে তো-তো-তোতলা? ঠিক কইছি না?

আমি কী যেন বলতে যাবো, তার আগেই মা বললেন, বুইঝঝি। যা অন পড়তে বয়। আঁই তরকারি গরম করি। খাইদাই খেলতে যাইস। এরপর কোনো কথা চলে না। ছোট ভাইয়ের কথায় যতটা গোখরা সাপের মতো ফোঁস করে উঠতে চেয়েছিলাম, মায়ের কথায় ততটাই ভেজা বেড়াল হয়ে গেলাম।

সেদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বসলাম উঠানে ঘনঘাসের ওপর। আমাদের ঘরকে পিঠের দিকে রেখে পশ্চিমুখী। সূর্যটা কেমন যেন মদিনার দিকে ডুবতে চললো। আহা! মদিনা না জানি কত দূরে? আচ্ছা মক্কা যেদিকে, মদিনাও তো সেদিকে! তাহলে মক্কায় রবি ওঠে কিভাবে? অঙ্ক মেলাতে পারি না। নিজের চোখেই তো দেখলাম, বাড়ির পেছনে নদীর ভেতর থেকে গোসল করতে করতে সূর্যটা  আকাশের দিকে উঠলো। তাহলে কিভাবে বিশ্বাস করি—সেই সাতসমুদ্দুর তেরো নদীর পারে পশ্চিমের কোনো এক মক্কা থেকে সূর্যটা ওঠে?

মরিয়ম  আদুরে গলায় বলে ওঠে—‘আরে আমার জামাই দেখি কান্দে!’ তার কথায় সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।

ভাবতে ভাবতে অকুলপাথারে ডুবে গেলাম। ধুর ক্যান যে স্কুল ছেড়ে মাদ্রাসায় গেলাম! স্কুলে পড়লে তো এতদিনে মরিয়মের সঙ্গে ক্লাস সিক্সে পড়তাম। সিক্সে নাকি ভূ-গোল পড়ায়। সেখানে দেশ-বিদেশের অনেক কথা আছে। কোন দেশ থেকে, কোন দেশে কিভাবে যায়, দূরত্ব কত—সবই আছে। আমি ক্যান যে হাফেজি পড়তে গেলাম! এখন কিছুই জানি না। তোতলামির জন্য ভালো করে কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারি না। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এসব ভাবতে ভাবতে আমার কান্না চলে এলো। টপটপ করে চোখের পানি পড়তে লাগলো ঘাসের ওপর। চোখ ঘোলা হয়ে এলো। হাতের তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলাম। দেখি মরিয়ম দাঁড়িয়ে। তার পেছন পেছন ইউসুফ, জাফর, লালি, কালি, ফাতেমা, সানা, জসিম, মাহফুজ, কামেস, নুর আলম, সেলিম, ইসমাইল—সবাই। মরিয়ম  আদুরে গলায় বলে ওঠে—‘আরে আমার জামাই দেখি কান্দে!’ তার কথায় সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। আকস্মিক ঘটনায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিছু বলার আগেই মরিয়ম আমার পাশে বসে। বাকিরাও আমাদের সামনে গোল হয়ে বসলো।

আলোচনার বিষয় নির্বাচন। এর আগে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে দেশের রাজা বা রানি। আমাদের মধ্যে রাজা হওয়ার মতো যোগ্য কেউ নেই। কারণ সবাই ক্লাস ফোরের নিচের ছাত্র-ছাত্রী।  রানি হওয়ার মতো আছি শুধু সে। যদিও মরিয়ম বয়সে আমার বয়সী। কিন্তু আমি বারবার স্কুল যাওয়া বন্ধ করা, মাদ্রাসায় পড়া, এসব করতে করতে পিছিয়ে পড়েছি। ফোরে ওঠার পরই মাদ্রাসায় চলে গেলাম। স্কুলে পড়া আর হলো না।

এত্ত সুন্দর হুতুলের  (পুতুলের) মতো কন্যা। হেতি রাজি। আর ভূতের কালা পোলা তুই, ভাব ধরোছ ক্যা? তোর এত দেমাগ কিয়ের? মাইয়া তো তোর তুনো হড়ালেহাও বেশি!

যাক সে কথা। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। শিক্ষাগত যোগ্যতার হিসাব করলে মরিয়মই রানি হওয়ার যোগ্য। তাই সে কারও অভিমতের তোয়াক্কা না করেই ঘোষণা করলো—তোদের মধ্যে আমি বড়। পড়াশোনাও বেশি করেছি। তোরা কেউ রাজা হওয়ার যোগ্য নোস। কিন্তু রানি হওয়ার মতো আমি আছি। তাই আমি রানি। তোরা কী বলিস?

তার এই প্রস্তাবে সবার আগে, আমার ভাই বললো, ঠিকই কইছস আপা। তুই রানি। এবার রানি কোনো ভূমিকা না করেই বললো, দেশে নির্বাচনের প্রয়োজন, চেয়ার‌ম্যানের ভোট করতে হবে। তবে চেয়ার‌ম্যানের চনের ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে হয়। সেটা তো তোরা কেউ জানছ না। জানবি ক্যামনে? সব তো গরু-ছাগরের দল। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে দেশের রাজা বা রানি। রাজা নেই, রানি আছি। আমি আমার ক্ষেমতা বলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ঘোষণা করলাম হকসাবকে। তোরা কী বলিস?

সমস্বরে সবাই বললো, ‘মানলাম।’

এরপর মরিয়াম ও আমি ছাড়া সবাই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। এক অংশের চেয়ার প্রার্থী জাফর। আরেক অংশের প্রার্থী ইউসুফ।  জাফরের প্রতীক হারিকেন।  ইউসুফ নিলো গেজুর গাছ।

আমাদের বাড়িলাগোয়া দক্ষিণ পাশে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা। রাস্তা পার হলেই কাসেমদের বাড়ি। কাসেমের বাবা জিলাপি-মোয়া বিক্রি করেন। দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীই তাকে ধরলো—ওই কাইশ্যা, যা তোর বাপেরতুন দুই সের জিলাপি নিয়ে আয়। কাইলকা ধান দিমু। কাসেম বাকিতে জিলাপি আনতে কিছুতেই রাজি হয় না। একে তো বাকি আনার ভয়, তারও চেয়ে ভয়—তার বাবা যদি জানতে চান কার জন্য? তখন সে কী বলবে? বিষয়টি নিয়ে আবার শুরু হলো শলাপরামর্শ। যে যত প্রস্তাবই দেয়, মরিয়ম সবই নাকচ করে দেয়। সে হলো স্বঘোষিত রাজ্যের রানি। তার কথার ওপর তো কারও কথাও চলে না। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে মরিয়মের উদ্দেশে লালি বললো, ‘এলা শালী। তোতলার বউ। তুই তো রানি। তোর বুদ্ধিও বেশি। তুই কই দেনা, বুদ্ধিটা কী?’

এবার মনে হয় ওষুধে কাজ দিয়েছে। মরিয়ম মুচকি হেসে বলে, ওলো সই, তুই তো আমারে তোতলার বউ কইয়া দিলি। কিন্তুক তোতলা কি আমারে বউ মানে? এবার লালি আমার কাছে আসে। বলে, ওই তো-তো-তোতলা? সমিস্যাটা কী? তোর মা, মরিয়মের মা বেয়াইন পাতাইছে। তোরা বড় অইলে তোগোরে বিয়া দিবো। এত্ত সুন্দর হুতুলের  (পুতুলের) মতো কন্যা। হেতি রাজি। আর ভূতের কালা পোলা তুই, ভাব ধরোছ ক্যা? তোর এত দেমাগ কিয়ের? মাইয়া তো তোর তুনো হড়ালেহাও বেশি!

মরিয়ম ও আমি নিরাপদ দূরত্বে ছিলাম বলে বাউকুড়ানি বাতাস আমাদের নাগাল পায় না। হয়তো তাই মনের দুঃখে কিছু দূর গিয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেলো সেই দুষ্টু বাউকুড়ানি বাতাস!

এবার কিন্তু আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। সাঁ করে উঠে দাঁড়ালাম। চিৎকার করে কী যেন বলতে গেলাম। শব্দ বের হলো না। কেবল গোঁৎ গোঁৎ করতে লাগলাম। মরিয়ম বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো, আরে কী শুরু করলি লালি? থাম। আমার দিকে তাকিয়ে কপট চোখ রাঙানি দিয়ে বললো, ওগো, আপনি আর রাগ কইরেন না। এখন কিন্তু আমি রানি। আপনি আমার অধীনে নির্বাচন কমিশনার। আমার সামনে ভদ্রভাবে থাকেন। বলতে বলতে আমার মাথায় বোলাতে লাগলো। আর আস্তে করে বললো, যখন-তখন যার-তার গায়ে হাত তুলতে যাস ক্যান? তোর হাত কিন্তুক খারাপ। তোর চড় খাইয়া আমির হোসেন যে জ্বরে পুড়ে মরছে, অহনো তো দুই বছর অয় ন। মনে আছেনি?

মরিয়মের কথা শুনে ভড়কে গেলাম। একবার একজনের গায়ে হাত তুলেছিলাম। সে জ্বরে পুড়ে কদিন পরে মারা গেলো। এখন যদি কারও গায়ে হাত তুলি, আর তারও যদি এমন কিছু হয়, তাহলে তো বাবা আমাকে পিটিয়ে জ্যান্ত কবর দেবেন। মরিয়মের সতর্কবাণীতে আমি দমে গেলাম। চুপ করে থাকলাম কিছুক্ষণ। এবার মরিয়ম বললো, শোন কাইশ্যা। আমার আব্বার কথা কইবি। কইবি আমাদের বাড়িতে আসরের নামাজের পর মিলাদ অইবো। এজন্য জিলাপি লাইগবো। কাইল জিলাপির বদল ধান দিয়া দিমু।

মরিয়মের প্রস্তাবটা কাসেমের মনে ধরে। সে এবার দে ছুট। কাশেম যাওয়ার পর বাকিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। এক গ্রুপ আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে স্লোগান দেয়, ‘আমার ভাই তোমার ভাই/ জাফর ভাই, জাফর ভাই।’ আরেক গ্রুপ উত্তর পাশে মিছিল ধরে—‘ইছুপ ভাইয়ের দুই নয়ন/ আঙ্গো সবার উন্নয়ন।’ মিছিল করতে করতে দুই পক্ষ কখনো কখনো মুখোমুখিও হয়ে যায়। যখন দুই পক্ষই মুখোমুখি হয়ে যায়, তখন স্লোগানোর ভাষা আর বোঝা যায় না।  ‘জাফর-ইছুপ, ইছুপ-জাফর’ ইত্যাকার শব্দের তোড়ে বাতাসও যেন হালকা বিনোদন পায়। একটা বাউকুড়ানি বাতাস এসে নাড়ার টুকরো-ধুলোর ঘূর্ণি তুলে সবার নাকেমুখে ঢুকিয়ে দেয়। এবার কাশিতে-হাঁচিতে সবাই প্রায় ধরাশায়ী। মরিয়ম ও আমি নিরাপদ দূরত্বে ছিলাম বলে বাউকুড়ানি বাতাস আমাদের নাগাল পায় না। হয়তো তাই  কিছু দূর গিয়েই শূন্যে মিলিয়ে যায় দুষ্টু বাউকুড়ানি বাতাস!

জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৬

চলবে…  

মন্তব্য