অন্যান্য

প্রাচীর


তহমিনা স্নান সেরে বাইরে টাঙানো তারের ওপর শাড়ি, ব্লাউজ ও পেটিকোর্ট নেড়ে দিচ্ছে। একতলা ঘরের ছাদে বসে দেখছে শফিক আহমেদ। শীতের মিষ্টি রোদের ওম, শফিক আহমেদের শরীর ও মনে যেন, দীর্ঘসময়ের আরাম খুঁজে পাচ্ছে।

রফিক, আযাদ ও শাহিদা তিনজনই ইংল্যান্ডে থাকে। তারা শুধুই টাকা পাঠায়। তাদের মা দিলারা খাতুন পরপারে চলে গেলো, তারা দেখতেও আসেনি। শুধু ভিডিওতে মায়ের লাশ খাটোয়া থেকে দেখে নিয়েছে।

তারপর গ্রামের মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনেরা কবরে রেখে এসেছে লাশটি। কবরে লাশ রেখে আসার পর শফিক আহমেদ একা হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজনেরা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, অনেক মেয়ের বাবাকে। বাবা টাকা-পয়সা জমি-জায়গার লোভে রাজি হলেও, মেয়ে রাজি হয়নি। মেয়েরা বলেছে, তারা বুড়ো মানুষকে বিয়ে করতে পারবে না।

এ কথা শুনতে শুনতে শফিক আহমেদ ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর বিয়ে করবে না।

শফিক আহমেদের প্রতিদ্বন্দী প্রতিবেশী তহমিনা খাতুন। সেও পাল্লা দিয়ে, উচ্চশিক্ষা অর্জন করিয়ে, তিন ছেলেকে কানাডায় পাঠিয়েছে। স্বামী ছিল, কলেজ শিক্ষক, সেও পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে। মৃত্যুবরণ করলে, তিন ছেলের পক্ষে বড় ছেলে, দেশে এসে, তাদের বাবার কবর দেওয়া, কালাম-খতম পড়ানোসহ প্রয়োজনীয় সব অনুষ্ঠান করে, কানাডায় পাড়ি জমিয়েছে। এই গ্রামের মানুষজন, এ বাড়ি দুটো পরিবারের বাবা-মাকে, সব সময় বলেছে, ধন্য-ধন্য। এমনকি গ্রামের বিভিন্ন উৎসবে, তাদের ডেকে, সম্মান বা পদক দিয়ে বলেছে, স্বর্ণগর্ভধারিণী মা ও গর্বিত পিতা।

শীতের শেষ সময়। বসন্ত আসি-আসি করছে। শফিক আহমেদ একা-একা বসে থাকে। গাঁয়ের এক মেয়ে এসে, রান্না-বান্না ও ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে চলে যায়। শফিক আহমেদ ছাদে বসে পত্রিকা পড়ে আর উদাসভাবে এদিক-ওদিক তাকায়। একটা দৈনিক ও একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বাড়িতে দিয়ে যায় হকার। দৈনিক পত্রিকাটি বাড়ি পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যায়। পরের দিন সেই পত্রিকা হাতে করে ঘরের ছাদে চেয়ার পেতে বসে পড়ে।

তহমিনা খাতুন মৃদু হাসতে হাসতে বলে, আমার তো এখন আর ঘর পাহারা দেওয়ার কেউ নাই, তোমার যা ভালো মনে হয়, তাই করো।

তহমিনা খাতুনেরও সময় কাটতে চায় না। তাই সকাল-সকাল নিজেই ঘরদোর মুছে, রান্নাবান্না সেরে স্নান করে। তহমিনা খাতুনের একতলা বাড়ি। সামনে বড় উঠান রয়েছে। ফুলের বাগানে গাছগুলো বেশ রঙিন হয়ে উঠছে, বসন্তের আগমনী বার্তায়।
আজ কাপড়চোপড় নেড়ে দিতে দিতে শফিক আহমেদের চোখে চোখ পড়ে।

দু’জনেই খানিক নীরব থাকে এবং অপলক ও অসহায় চোখ যেন আবেগঘন হয়ে ওঠে।
তহমিনা খাতুনই মুখ খোলে, শুধু পত্রিকা পড়ে কি দিন যায় ভাই?

শফিক আহমেদ না ভেবে, ঝটপট বলে, ঘরমুছে আর শুধু রান্না করেই কি তোমার দিন যায়?

তহমিনা খাতুন একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তারপর ঘাড়ে রাখা তোয়ালেটা তারের ওপর দিতে দিতে বলে, কী আর করি ভাই?- তোমার সাথে পাল্লা দিয়ে ছেলি পড়ি তো বিদেশ পাঠালাম, এখন তো বুড়িকালে একা হবো কোনোদিনই ভাবিনি।

শফিক আহমেদ হো-হো করে, উচ্চস্বরে হেসে বলে, যদি বলতে বলো, একটা কথা বলি?
শফিক আহমেদের কথা শোনার জন্য তহমিনা খাতুন অপেক্ষা করে, মুখে কিছু বলে না।
শফিক আহমেদ পত্রিকাগুলো গোছাতে গোছাতে বলে, এতকাল যে জমির আল ঠেলাঠেলি করেছি, প্রাচীর দেওয়া নিয়ে বারবার আমিন এনে জমি মেপেছি, মন কষাকষি করেছি। সে প্রাচীরের দেয়াল ভেঙে দিলে কেমন হয়?

তহমিনা খাতুন মৃদু হাসতে হাসতে বলে, আমার তো এখন আর ঘর পাহারা দেওয়ার কেউ নাই, তোমার যা ভালো মনে হয়, তাই করো।

শফিক আহমেদ পত্রিকাগুলো দু’হাতে কড়মড় শব্দে মড়িয়ে-গুছিয়ে তহমিনা খাতুনের উঠানে ফেলে দেয়। পত্রিকা মড়ানোর শব্দে, দু’বাড়ির সীমানা প্রাচীরে ফাটল ধরে।

মন্তব্য