কলাম

ফেলে আসা দিন 


চরক্লার্ক উচ্চ বিদ্যালয়। পেরিয়ে এলো গৌরবময় পঞ্চাশ বছর। সুবর্ণজয়ন্তী আয়োজনে চারদিকে সাজ সাজ রব। প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে আয়োজন হচ্ছে এক মহামলিন মেলার। চারিদিকে আনন্দ আর উদ্দীপনার ছড়াছড়ি। কিন্তু আজকের এই প্রজন্ম কি জানে, এই জৌলুস, শান-শওকতপূর্ণ মহৌৎসবের ইতিহাস? জানা দরকার। তাদের জানানোর তাগিদেই আমাদের রোমন্থন করতে হবে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি।

এই তো সেদিনের কথা, শিক্ষকতা দিয়েই শুরু হয়েছিল আমার কর্মজীবন। মরহুম মৌলবি মজিবল হকের অনুরোধে যোগদান করি ‘চরক্লার্ক দাখিল মাদরাসা’য়। মাত্র অল্প কিছুদিন সেখানে শিক্ষকতা করেছিলাম। তৎকালীন আক্তার মিয়ার হাটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাফেজ ফজলুল করিম (সম্পর্কে ভগ্নিপতি), তার সুবাদে পরিচয় হয়েছিল চরক্লার্কের বিশিষ্ট সমাজসেবক মরহুম মাস্টার ছিদ্দিক উল্লাহর সঙ্গে। তিনিই আমাকে চরক্লার্ক হাই স্কুলে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালেন। দিনে দিনে তার সঙ্গে যে হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা উপেক্ষা করতে পারিনি। বলতে গেলে, তিনিই একপ্রকার জোর করেই আমাকে মাদরাসা ছেড়ে স্কুলে আসতে বাধ্য করলেন।

চরক্লার্ক হাই স্কুল। স্কুল বলতে ৬০/৬৫ ফিট লম্বা একটি টিনের ঘর। এখানেই পাঠদান করতাম। ছাত্র সংখ্যাও তখন খুবই নগণ্য। গুটিকয়েকজন ছাড়া অনেকের কথা এখন আর মনেও নেই। ওই সময় যাদের ফ্রন্ট লাইনে দেখেছি, আজও তারা ফ্রন্ট লাইনে রয়েছে! আমারই প্রিয় ছাত্র ‘ছানাউল্যাহ বিকম’, আজ সেই প্রতিষ্ঠানেরই প্রধানের দায়িত্ব পালন করছে। আমাদের আরেক স্নেহের ছাত্র ‘মাস্টার নূর আলম’, সেও আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান। ইউছুপ, জিল্লু, আজাদ, আলেয়া, ছালেহাসহ অনেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আমার আরেকজন প্রিয় ছাত্র নূর হোসেন (মরহুম নুরুল হক কেরানির ছেলে), ছাত্র হিসেবে অনেক মেধাবী ছিল।

সত্তুরের দশক। তৎকালীন চরবাটায়ই শিক্ষার হার ছিল খুবই কম; চরক্লার্ক অঞ্চল ছিল আরও অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহও তেমন ছিল না। তবে শিক্ষিত মানুষের প্রতি এই অঞ্চলের মানুষের ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। তৎকালীন এই স্কুলটি একটি জুনিয়র হাইস্কুল হিসেবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের জন্য স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ছিল। প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষক সংখ্যা সাকুল্যে ছয়জন। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু সন্তোষ চন্দ্র দাস (পরবর্তী সময়ে চরবাটা রামগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক)। আমি ছাড়া অন্যান্য সহকারী শিক্ষক ছিলেন, মাস্টার নূরনবী, মরহুম মাস্টার জাফরউল্যাহ, মাস্টার আবুল খায়ের ও মাস্টার ফজলুল হক।

আজকের মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের সঙ্গে তৎকালীন চরক্লার্ক ইউনিয়নের তুলনাই চলে না। আজকের এই জনপদ অনেক গুণীজনের পদচারণায় মুখরিত। অথচ সত্তরের দশকে স্কুল আঙিনার বাইরে কোথাও বসে একটু গল্প-গুজবের পরিবেশও ছিল না। ফলে বাধ্য হয়েই স্কুল ছুটির পরে আমাদের স্কুলেই অবসর কাটতো। ওই সময় মন চাঙা রাখার জন্য আমাদের সঙ্গ দিতে যারা স্কুলে ছুটে আসতেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন মাস্টার আকরাম হোসেন হেনারী, মরহুম মোজাক্কের মিয়া, মরহুম শাহ আলম মেম্বার, মরহুম খুরশিদ আলম মেম্বার, আবদুল খালেক মিয়া, মরহুম মাস্টার ছিদ্দিক উল্লাহসহ অনেকেই। সবার নাম স্মরণ করা কঠিন। আমার আগে-পরে স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হিতাকাঙ্ক্ষী আরও অনেকেই ছিলেন। মনে পড়ে, মরহুম ছোলায়মান চেয়ারম্যান, মরহুম হারিস মেম্বার, নুরুল আহাদ মেম্বার, ভোলন মেম্বারসহ অনেক শিক্ষানুরাগীকে। অভিভাবকরা স্কুলে তেমন আসতেন না। তবে কোথাও দেখা হলে যে সম্মান-তাজিম করতেন, আজকের দিনে তা কল্পনাও করা যায় না। মরহুম নুরুল হক কেরানি, বয়সে প্রায় আমার বাবার বয়েসী হলেও তাকে আগে সালাম দেওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল।

তখনকার দিনের কিছু স্মৃতি মনে পড়লে এখনো মনে ভয় জাগে। বর্ষা মৌসুম। রাস্তাঘাটের অবস্থা মোটেই সুবিধার ছিল না। কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল। ছাতা মাথায় পাঁয়ে হেঁটে চরবাটা থেকে চরক্লার্ক (মোহাম্মদপুর) যাওয়া যে কী কঠিন ব্যাপার, আজকের দিনে চিন্তায়ও আনা যায় না। মরহুম মাওলানা শফিকুর রহমান, শিক্ষকতা করতেন চরক্লার্ক দাখিল মাদরাসায়। বেশিরভাগ সময় আসা-যাওয়ার সঙ্গে ছিলেন তিনি। ভদ্রলোক বেশ হাঁটতে পারতেন। তার সঙ্গে আমাকে প্রায় দৌঁড়াতে হতো। সপ্তাহের শুরুতে পায়ে হেঁটে স্কুলে পৌঁছা, সপ্তাহান্তে একইভাবে বাড়ি ফেরা। একবার এমনও হয়েছে, বাড়ি থেকে চরক্লার্ক পর্যন্ত এসে পিছলে গিয়ে কাদা মাখামাখি, আবার ফিরে গিয়ে পোশাক বদলে স্কুলে ফিরেছি। আহা! নামমাত্র মাইনে, দুভোর্গের পর দুর্ভোগ।

মাঝে মাঝে মনে হতো, আর পারব না। কিন্তু এই বন্ধুর-কঠিন পথ পেরিয়ে যখন স্কুল আঙিনায় পৌঁছতাম, সহকর্মীদের আন্তরিকতা আর শিক্ষার্থীদের মাঝে এসে সব কষ্ট নিমিষেই উধাও হয়ে যেতো।

চরক্লার্ক হাই স্কুল আজ বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত। এর পেছনে অনেকেরই নিরলস শ্রম-ঘাম ছিল। স্কুলের তৎকালীন প্রধানশিক্ষক বাবু সন্তোষ চন্দ্র দাসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ না করলে কৃতজ্ঞতা আদায় হয় না। তার মতো কঠিন পরিশ্রমী এবং ধৈর্যশীল মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। চরক্লার্ক ছিল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। যে কারণে স্যারের জন্য কোনো লজিংয়ের সুযোগ ছিল না। বাধ্য হয়েই তিনি স্কুলের অফিস রুমের পাশে ছোট্ট একটা কক্ষে রাত্রিযাপন করতেন। নিজেই রান্না-বান্না করে খেতে হতো। আজকের এই প্রতিষ্ঠানটি সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে তার এই আত্মত্যাগ অনেক বড় শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল। প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য অনেকেই নিঃস্বার্থভাবে নিরলস শ্রম দিয়ে গেছেন। স্মৃতির গহ্বরে ভেসে ওঠা আরেক মহৎপ্রাণ মানুষ মৌলবি ওবায়দুল হক।

স্কুলে যোগদানের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি একপ্রকার জোর করে আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। তার মেঝ ছেলে অলিউদ্দিন মিয়ার ঘরেই হয়েছিল আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। প্রায় দুই বছর তারা আমাকে পরম যত্নে রেখেছিলেন তাদের বাড়িতে। বার্ধক্যজনিত কারণে অলিউদ্দিন মিয়া এখন খুবই কষ্টে আছেন; আল্লাহর কাছে তার সুস্বাস্থ্য ও নেক হায়াত কামনা করছি।

একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরুতে আশা-হতাশা এবং নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। চরক্লার্ক উচ্চ বিদ্যালয়ও তার ব্যতিক্রম নয়। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি আজ সুনামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। শহর থেকে অনেক দূরে নিরিবিলি একটি গ্রামের মধ্যে হলেও এই বিদ্যালয় এখন নোয়াখালীর অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ক্রমশ, সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এই স্কুলটির কারণেই বৃহত্তর চরক্লার্ক জনপদ আজ শিক্ষার আলোয় আলোকিত। এই প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী এখন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে-বিদেশে স্বীয় কর্মক্ষেত্রে নিজ এলাকার গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছে।

অনেক দিনের পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত দাতা, প্রতিষ্ঠাতা, সহযোগী, হিতাকাঙ্ক্ষী অনেকের কথাই আলাদা করে উল্লেখ করতে পারিনি, অনেককে স্মরণও করতে পারিনি। এই অক্ষমতার জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।

লেখক: প্রাক্তন শিক্ষক, চরক্লার্ক উচ্চ বিদ্যালয়। ঠিকানা: খাসের হাট, চরবাটা, সুবর্ণচর, নোয়াখালী। ফোন: ০১৭১০৬৪০২১৮

মন্তব্য